
ইরাজ আহমেদ
তখনো এই ঢাকা শহর মানুষের ভীড়ে এতো সয়লাব হয়ে যায় নি। ঢাকা স্টেডিয়ামের এক তলায় প্রভিন্সিয়িাল নামে একটি মিষ্টির দোকান ছিলো। এখনকার মতো সাজানো-গোছানো আর চটকদার কোন মিষ্টির দোকান ছিলো না সেটা। কিন্তু এই শহরের মিষ্টিবিলাসী মানুষ প্রভিন্সিয়ালের মিষ্টি খেতে পছন্দ করতো। শৈশবে বাড়িতে অনেক মেহমান এলে প্রভিন্সিয়ালের মিষ্টি থাকতো অতিথি আপ্যায়নের তালিকায়। দারুন মজার এক সন্দেশ তৈরী হতো প্রভিন্সিয়িালে। ওপরটা হালকা হলুদ রঙের সরে ঢাকা। ভেতরটা ছানা। প্রভিন্সিনয়ালের রাজভোগ তখন খুব খ্যাতিমান ছিলো। বড় সাইজের হাতের মুঠোর সমান এক রসগোল্লার নাম ছিলো রাজভোগ।মিষ্টিটা কেটে ফেললে ভেতরের কেন্দ্রস্থল থেকে বের হতো সুগন্ধী এলাচ। প্রভিন্সিয়াল দোকানটায় খুব ভীড় লেগে থাকতো সব সময়। ঢোকার মুখেই কাঠের তৈরী মিষ্টির আলমারি। তাতে লাগানো ছিলো কাঁচের স্লাইডিং দরজা।ওই স্লাইডিং দরজাটাও ছোটবেলায় আমার কাছে রাজ্যের বিষ্ময়ের উৎস ছিলো।
ওই দোকানের ভেতরে বসে মিষ্টি খাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। এরকম বসে মিষ্টি খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল জলখাবার আর মরণচাঁদেও। তখন প্রভিন্সিয়াল ছাড়া এ দুটি মিষ্টির দোকানও বিখ্যাত ছিলো। এই মিষ্টির দোকানগুলো প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। ঢাকায় তখন বিভিন্ন পাড়ায় কিছু মিষ্টির দোকান ছাড়া তেমন পরিচিত মিষ্টি ব্যবসায়ী ছিলো না। ঢাকার নিউমার্কেটে কয়েকটি বেকারী ছিলো। সেখানে মনে আছে, বিহারি ময়রাদের তৈরী এক ধরণের শুকনো লাড্ডু পাওয়া যেতো। কোন কোন লাড্ডু আবার বসানো থাকতো নকশা করা ছোট্ট কাগজের ওপর।
ছোটবেলায় মিষ্টির দোকানে বসে মিষ্টি খাওয়ার জন্য মনের মধ্যে অতৃপ্ত এক বাসনা কাজ করতো। কিন্তু তখন কেন জানি না বাড়ির বড়রা দোকানে বসে মিষ্টি খেতে দিতো না।তাই কাগজের এক ধরণের নরম বাক্স অথবা শালপাতার ঠোঙ্গায় মিষ্টি কিনে বাড়ি ফেরাটাই ছিলো রেওয়াজ। যে সময়ের কথা বলছি তখনও ঢাকা শহরে মিষ্টির দোকানের কোন আলাদা বাক্স তৈর হয় নি। বাক্সের ওপর কোনরকমে দোকানের নাম ছাপানো থাকতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনেক বছর মিষ্টির বাক্সের প্রতি এই অবহেলা কাটেনি।
তেখন মাপের ক্ষেত্রে কেজির প্রচলন হয় নি। সের হিসেবে মানুষ মিষ্টি কিনতো।এখন অবশ্য মিষ্টির দোকানে মিষ্টির চাইতে বাক্সের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় সেগুলোর চাকচিক্যের জন্য।
মরণচাঁদ আর জলখাবারে মিষ্টির পাশাপাশি অসাধারণ সিংগাড়া তৈরী হতো। তৈরী হতো হালুয়া আর পরোটা। সকালবেলা অনেক মানুষকে দেখতাম মিষ্টির দোকানে বসে নাস্তা খাচ্ছে। পুরান ঢাকায় এই ব্যাপারটা রেওয়াজের মধ্যে পড়লেও নতুন শহরে সেরকম কোন নিয়ম ছিলো না। প্রভিন্সিয়াল মিষ্টির দোকানেও ভোরবেলা এরকম নাস্তার আয়োজন ছির বলেই মনে পড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিষ্টির ব্যবসা তুলে দিয়ে দোকানটি রেস্তোরাঁ হয়ে যায়। তবে সেই হলুদ রঙের সন্দেশ আর রাজভোগের স্বাদ আজো জিবে লেগে আছে।আশির দশকে শান্তিনগরে মিষ্টির দোকান হিসেবে প্রখ্যাত হয়ে ওঠে ‘মধুমিতা মিষ্টি ঘর’। এই মিষ্টির দোকানটি একসময়ে আমার আড্ডাস্থল ছিলো। সেই সুযোগেই মধুমিতায় সেরে ফেলতাম সকালের নাস্তা, পরোটা আর বুন্দিয়া অথবা নিরামিষ।
মিষ্টির দোকানে এখন আর সেই কাঠের আলমারিগুলো নেই। নেই মিষ্টির সেই আঠালো গন্ধ। থাকার প্রশ্নও ওঠে না। কাঠের বেশ নকশাকাটা আলমারি থাকতো তখন মিষ্টির দোকানে। যেরকমটা আজো কোন মফস্বল শহরে চোখে পড়ে। সেই আলমারির ভেতরে ঢুকে বসে থাকতো রাজ্যের মাছি। কোন কোন দোকানে দেখেছি মাছি আটকাতে টানা পাখার ব্যবস্থা থাকতো। মাঝে মাঝে সেই পাখা নেড়ে তাড়ানো হতো মাছি। সেই আলমারির জায়গা এখন দখল করেছে আধুনিক সংরক্ষণ সুবিধা সম্বলিত আলমারি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিষ্টির দোকানে আগের মতো আর আড্ডাও বসে না।বদলে গেছে মিষ্টির ধরণ, গড়ন এবং নাম।আগের সেই মুখস্ত তালিকার মতো রসগোল্লা, চমচম, পান্তোয়া, কালোজাম আর মনসুরের যুগ পার হয়ে নতুন নতুন অনেক মিষ্টি যোগ হয়েছে তালিকায়। ভোল পাণ্টানো এই শহরের মতো পাল্টে গেছে শহরের মিষ্টির দোকান। কিন্তু কারো কারো মনে হয়তো রয়ে গেছে সেই স্বাদ আর গন্ধ।