পোস্টবক্স। ফেইসবুকের একটি জনপ্রিয় গ্রুপ। এবার প্রাণের বাংলার সঙ্গে তারা গাঁটছড়া বাঁধলেন। প্রাণের বাংলার নিয়মিত বিভাগের সঙ্গে এখন থাকছে পোস্টবক্স-এর রকমারী বিভাগ। আপনারা লেখা পাঠান পোস্টবক্স-এ। ওখান থেকেই বাছাইকৃত লেখা নিয়েই হচ্ছে আমাদের এই আয়োজন। আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন। থাকুন পোস্টবক্স-এর সঙ্গেও।

ফারহানা নীলা
তখন আমার বয়স ছয় বছর। সময় মিলিয়ে অনেক কিছুই মনে নেই। তবে কিছু কিছু স্মৃতি কখনোই ভুলি না।
সালটা ১৯৭১। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সুপারের বাসাটা বিশাল মাঠের কোণায়। পাশেই আরএম একাডেমি স্কুল।
মনে পড়ে একরাতে সারারাত খাটের নীচে আমরা। আব্বা আম্মা আতংকে চুপচাপ। গুলির আওয়াজ বাহিরে।
সকাল হলো। রাতারাতি মাঠের উপর অনেক তাবু। অনেক আর্মি মাঠে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আব্বা এগিয়ে গেলো।আম্মা আব্বাকে যেতে দেবে না। আব্বা তবুও এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। আর্মিরা পানি খেতে এসেছে। আমাদের ডেকে চকলেট দিলো। হেসে বললো ভয় নেই।
এডওয়ার্ড কলেজের ইংরেজি শিক্ষক রশিদুল্লাহ কাকা এলেন বাসায়। বললেন আজ রাতেই আব্বাকে সহ সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে।
কাকা আমাদের তিন ভাই বোনকে নিয়ে হেঁটে সাঁকোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। গন্তব্য ওইপারে জালাল কাকার বাসা। জালাল কাকার ছোট মেয়ে শেবু আমার বন্ধু। আর্মিরা জিজ্ঞেস করছে কোথায় যাই আমরা। কাকা হেসে বললেন বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যাই। মাগরিবের নামাজ শেষে আব্বা আম্মা আর্মিদের জানিয়ে আমাদের আনতে গেলো।
সব ঠিক করাই ছিলো। জালাল কাকার বাসা থেকে হেঁটে রওনা হলাম আমরা। আমরা পালিয়ে যাচ্ছি। শোভন তখন ছোট। হাঁটতে পারে না বেশী। আব্বার পিওন সাইকেলে চড়িয়ে শোভনকে নিয়ে এগুতে থাকে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। রাত গভীর হয়। আমরা হাঁটছি। হাসান ভাই সাইকেল নিয়ে ফিরে গেছেন। শোভন আব্বা আম্মার কোলে।
এডরুকের কাছে গিয়ে রাস্তা বন্ধ। অনেক আর্মি টহল দিচ্ছে। আমরা পেছনের মাটির পথ ধরে হেঁটে চলেছি। গন্তব্য দাদার বাড়ি বলরামপুর।
দাদার বাড়ীর তেতুল তলায় ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছে। আমরা মই বেয়ে ট্রেঞ্চের মধ্যে নামি। আম্মা আমাদের তিনজনকে কোলে নিয়ে বসে দোয়া পড়ছে আর কাঁদছে। অনেক মানুষ আমাদের সঙ্গে। বম্বিংয়ের আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছি। ছোট চাচা ট্রেঞ্চের উপর গাছের মরা পাতা আর ডাল দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন।
লাহিড়ী কাকা তখন এডওয়ার্ড কলেজের প্রিন্সিপাল। মাসীমা নীরা’দি আর সুমনকে নিয়ে ঢাকায়। নীপা’দি ঢাকা মেডিকেল থেকে হারিয়ে গেছেন। নীপা’দির কোনো খবর কেউ জানে না। লাহিড়ী কাকা আমাদের সঙ্গে পালিয়ে দাদার বাড়িতে। আম্মা উনাকে কলেমা শেখায়। দাঁড়ি টুপিতে কাকাকে চেনা যায় না।
বলরামপুরও আর নিরাপদ নয়। দাদী দাদার লুঙ্গিতে গিঁট দিয়ে মুড়ি বেঁধে দিলো। বালিশ আর কাঁথা নিয়ে আমরা দোগাছির পথে। হাঁটছি আবার গাছের ছায়ায় বসছি। দোগাছির কাছে একটা পুকুরে আব্বা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে দিলো। আমরা গাছের নীচে বসে পানি খাই।
দোগাছিতে যেই বাসায় ছিলাম, তারা খুব গরীব। আম্মা খড়ির চুলায় রান্না করে আর কাঁদে। নানুদের কোনো খবর পায় না। সিদ্ধেশ্বরীতে নানুর বাড়ী।
কয়েকদিন দাদী রান্না করে ছোট চাচার কাছে পাঠাতো। একদিন ফিরে যাবার সময় ছোট চাচাকে আর্মি ধরে নদীর পাড়ে চোখ বেঁধে দাঁড় করায়। সঙ্গে আরো অনেক লোক। খুব মারে রাইফেল দিয়ে। কোনো একটা খবর আসায় ছেড়ে দেয় সবাইকে। বেঁচে যায় চাচা। বাড়ীতে গিয়ে পেশাবের সঙ্গে রক্ত আসে। চাচা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
একদিন সন্ধ্যায় আব্বা টমটম নিয়ে আসে। দোগাছিতে ছত্রী সৈন্য নামবে রাতে খবর পায় আব্বা। আমরা টমটমে করে চলছি। গন্তব্য শিবপুর।
শিবপুরে রাতে পৌঁছলাম। তারা আমাদের দেখে খুশী হলেন না। সেই রাতেই ছত্রীসৈন্য দোগাছি চষে ফেললো। কোনো বাড়ীতেই ছেলে ছিলো না। শিবপুরে পানের বরজ দেখলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলে আব্বা গরুর গাড়ী নিয়ে এলো দু’দিন পর। আমরা আবার চলেছি মৌদে। গন্তব্য মৌদে ফুফুর বাড়ী।
মৌদে প্রায় চল্লিশ জন আমরা আশ্রয় নিয়েছি। আব্বা পুকুরে মাছ ধরে। আমরা খেলি। বাড়ীগুলো টিলার মত উঁচুতে। পাশের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় আর্মি। দাউদাউ আগুন জ্বলছে।
একরাতে নৌকায় চড়ে জোছনায় ভেসে বিয়ে খেতে যাই। যুদ্ধের সময় বিয়ের দাওয়াতও খাই।মৌদে গাছ থেকে পড়ে গেলাম মনে আছে।
মৌদ থেকে মহিষের গাড়ী করে ফিরছি দাদারবাড়ী।
সবাইকে কাজে যোগদানের কথা বলা হলো। আব্বা কলেজে গেলো। বাসায় গিয়ে সেলাই মেশিনটা নিয়ে এলো। এরপর বাসার সবকিছু লুঠ হয়ে যায়। কিচ্ছু ছিলো না।
পরে নুরু চেয়ারম্যানের গোডাউনে শোভনের সাইকেল পাওয়া যায়।
দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তি বাহিনীর অনেকে আব্বার ছাত্র। কলেজের বাসায় ফিরে গেছি আমরা। হোস্টেলের কুয়ার ভেতর লুঠ করা অনেক মালামাল পাওয়া গেলো।
নুরু চেয়ারম্যানকে চুল ন্যাড়া করে জুতার মালা গলায় দিয়ে ট্রাকে করে ঘুরছে সবাই।
পুনশ্চঃ সময় এবং ঘটনা মিলিয়ে মনে করতে পারি না। স্মৃতি থেকে নেওয়া…. ভুল থাকতেই পারে।
ছবি:গুগল