
রাহুল পণ্ডা
ছোটবেলায় রেডিও শুনতাম খুব। রেডিওর দুটো নব, একটা ক্ষুদে, একটা বড়। ক্ষুদেটা দিয়ে শব্দ কমানো-বাড়ানো যেত, আর বড়োটা দিয়ে চলত চ্যানেল সার্ফিং। আমাদের কলকাতা ‘ক’ ছিল ১০২.৪ মেগাহার্টজ, বিবিধভারতী ১০১.৮ মেগাহার্টজ। বাড়িতে এ দুটোই চলত দিনভর, কিন্তু এতো অল্পে আশ মেটে না। আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরও খোঁজ করতাম, নতুন কী শোনা যায়। এভাবেই কখনো ধরে যেত রাজস্থানি ফোক, সাউথ ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল, ঝাড়খণ্ডের পরবের গান, গুজরাটি তামাশা, আরও কত কী। বয়স কম তখন, কিছুই বুঝতাম না, তবু বেশ লাগত শুনতে। অচেনা, অপিরিচিত সংস্কৃতির একঝলক যেন বেদুঈন বাতাসের মতো ছুঁয়ে দিয়েই হারিয়ে যেত। তাকে ধরার উপায় ছিল না, খালি অনুভবেই যতটা চিনে নেওয়া যায়। তা এরকমই একদিন, সন্ধ্যে তখন, রেডিওর নব ঘোরাচ্ছি খেয়াল খুশী। এমন সময় আচমকা লেগে গেল বাংলাদেশ বেতার। একদমই স্পষ্ট নয়, টানা ঘ্যাসে ঘ্যাসে শব্দ, কিন্তু কানের কাছে চেপে ধরলে একটু একটু শোনা যায়। ফ্যাঁস ফ্যাঁসে ওয়েবের বিরক্তি ঠেলে মাঝেমাঝেই ছিটকে আসে একটা-দুটো বাংলা শব্দ, বাংলা গান। প্রথমে ঠাওর হয়নি ঠিক। ভেবেছিলাম কলকাতা ক পালটে দুর্গাপুরটা লেগে গেল বোধহয়। তখন দুর্গাপুর, আসানসোল থেকেও একটা ব্রডকাস্টিং হত। কিন্তু কিছুক্ষণ শোনার পর ভুল ভাংগল। জেলাভিত্তিক খবর হচ্ছিল সেসময়, আমরা যাকে বলি স্থানীয় সংবাদ। কিন্তু সে খবরে ভাগীরথী-হুগলীর দুকূলজোড়া খবর নেই, পদ্মার হালচাল আসছে ভেসে। মালদা, দিনাজপুর, চব্বিশ পরগণার বদলে শোনা যাচ্ছে বরিশালের নাম, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুরের নাম, সুনামগঞ্জ, শ্রীহট্ট, রাজশাহীর নাম। এই নামগুলোর সবই প্রায় অচেনা, দু-একটা চেনা, তাও রোজকার আলাপে আসে না। তাই শুনতে গিয়ে ধাঁধাঁ লাগছিল, বারবার কানের কাছে ঠেকিয়ে দেখছিলাম, ঠিক শুনছি কিনা। ভাবুন একবার তখন আমার অবস্থা, বছর দশেকের পোলাপান শুনছে বাংলাদেশের খবর। কোথায় ঢাকা আর কোথায় মেদিনীপুর, হাজার মাইল দূরে মাঝবয়সী মণিরুল ইসলাম সায়ন গম্ভীর গলায় শুনিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের উথাল পানির রোজনামচা, আর আমি রেডিওর ফুটোয় শ্বাস আটকে শুনছি সেই নোনাগাঙ্গের ছলাতছল! তাজ্জব না! ভাবা যায় কখনো! অবাক হওয়ার আরও কারণ ছিল। সম্পূর্ণ ভিনদেশী একটা রেডিও স্টেশন থেকে মাতৃভাষায় কেউ কথা বলছে, এই অনুভবটাই কেমন জানি রূপকথা ঠেকে। দেখবেন বিদেশ-বিঁভুইতে কাউকে নিজের ভাষা বলতে শুনলে জড়িয়ে ধরতে মন চায়, তাকে খোয়া যাওয়া কলজের টুকরো বলে মনে হয়। আর এখানে তো খোদ বিদেশ থেকেই বাংলাভাষা ভেসে আসছিল। আবেদনটাই ভিন্নমাত্রার। তাছাড়া পূববাংলার ডায়ালেক্টে অপিনিহিতির নিজস্ব টান রয়েছে, হাবেভাবে উচ্চারণে আমাদের রুখা-সুখা রাঢ়দেশের সংগে মেলে না মোটে। ফলে শুনতে গিয়ে আরওই অদ্ভুত ঠেকে, বেশ মিঠে, খানিক শুনলেই নেশা ধরে যায়। মনে পড়ে, শীতলপাটি বিছানো খাটে উপুড় হয়ে, সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বাংলাদেশ বেতারে কান ঠেকিয়ে বসেছিলাম। কখনো শোনা যাচ্ছিল, কখনো হারিয়ে যাচ্ছিল, তবু কান সরাইনি, শুনেই যাচ্ছিলাম। সেই প্রথম বাংলাদেশের সংগে আলাপ আমার, সেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত শোনা, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’। এখন বড়ো হয়ে, শীতলপাটির আরাম গেছে। পড়াশুনোর জোয়াল ঠেলতেই দিনকাবার। তাতে ক্ষতি বিস্তর, মনের বয়স বাড়ছে হুহু করে, অকালপক্বতা ঘুঁচে লঘু মাথা পরিপক্ব হচ্ছে রোজ, শুধু জবাব দিয়ে মরশুমি ফজলির মতো খসে না পড়লেই হল। তবে লাভ একদম হয়নি এমন নয়, যেহেতু সাহিত্যের ছাত্র, প্রচুর বই পড়ার সুযোগ মেলে, আর সেই খাতিরে বাংলাদেশকেও নতুনভাবে চিনে নেওয়া যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও এখানকার স্কুল-কলেজের সিলেবাসে বাংলাদেশের লেখাপত্র থাকত না মোটে, থাকলেও নাম কে ওয়াস্তে, নেহাত জানাতে হয় তাই জানানো। এখন অবস্থা পালটেছে। বইপত্রের জোগান বেড়েছে, চর্চাও। আমাদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এদিক থেকে পথিকৃত। এখানেই প্রথম বাংলাদেশের সাহিত্য আলা
দা গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো শুরু হয়। ফলে ছাত্র হিসেবে বাংলাদেশের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, সবই পড়তে হয়েছে। আজিজুল হক থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ওয়ালীউল্লাহ থেকে শামসুল হক, সেলিনা হোসেন থেকে বদরুদ্দিন ওমর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ থেকে শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ থেকে আল মাহমুদ, মুনীর চৌধুরী থেকে সেলিম আল দিন, এই নামগুলো এখন বড্ড চেনা আমাদের, বড্ড আপন, ধূলো জমা বইয়ের তাক ঝেড়ে পড়ার মতো আদরের। ইলিয়াস আমার পছন্দের লেখক। ‘চিলেকোটার সেপাই’ সিলেবাসেই পড়তে হয়েছিল, আশ্চর্য বই, কিন্তু অফুরান ভালবাসা ‘খোয়াবনামা’-র জন্য। পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কি অসম্ভব সৎ! নির্ভেজাল বাঁধুনি! আঁকাড়া বাংলাদেশের এমন মায়াজড়ানো ছবি, জল-মাটি-স্মৃতি-ছায়া মিশে এমন আস্ত একখানা দেশের গল্প, আর কোথাও পাইনি আমি। বস্তুত এই উপন্যাসের জুড়ি হয় না, এক প্রজন্মে হয়তো একবারই লেখা সম্ভব। এভাবেই কখনো ইলিয়াস, কখনো ওয়লীউল্লাহ, কখনো আজিজুল হক বাংলাদেশ চেনান আমায়। তাঁদের কলম ছুঁয়ে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম ধরা দেয় আমার কাছে, বারবার পড়ি, চেতনার বুদুবুদে নকশা কাটে ‘মেঘনাপাড়ের দ্যাশ’। হাড্ডি খিজিরেরা স্বপ্ন দেখায় লালচে-সবুজ পতাকা একদিন উড়বেই আকাশজুড়ে। যাইহোক, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার শেষটুকু বলি। ফি বছর ষোলোই ডিসেম্বর বা একুশে ফেব্রুয়ারি এলে, স্মৃতিকাতর কলকাতার রাস্তায় যখন আচমকা বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’, তক্ষুনি ছোটবেলার সেই রেডিওটার কথা মনে পড়ে আমার। এখনও নব ঘোরানো সন্ধ্যেটা ঝাঁক মেরে ফিরে আসে। সে রেডিও আজ হারিয়ে গেছে বহুযুগ, হয়তো ভাঙাচোরা পড়ে আছে কোন স্টোররুমে, তবু তার হাত ধরেই প্রথম বাংলাদেশ চেনা আমার। চেনা যে কাঁটাতার বলে কিছু হয় না, আলাদা দেশ বলে কিছু হয় না। ভাষা এক হলে ছক কেটে দেওয়া মানচিত্র পালটাতে থাকে, ওয়েভের জট ছাড়িয়েও সে তখন পৌঁছে যায় একলা কিশোরের নিসঙ্গতায়, তার থমকে থাকা দিনযাপনে। ভরসা জোগায় পথ হারালে ভয় পেও না, সীমান্তের ওপারে আজও আছে তোমার দেশ।
ছবি: ইন্টারনেট, আনসারউদ্দিন খান পাঠান, প্রাণের বাংলা