বাবলু ভট্টাচার্য : প্রথাগত রোমান্টিক নায়ক হওয়ার জন্য তিনি তৈরি ছিলেন না, কিন্তু এতটাই ক্যারিশমাটিক ছিলেন যে তাঁকে দিয়ে দ্বিতীয় সারির কোনো চরিত্রে অভিনয় করানো সম্ভব ছিল না। আবার তিনি এতটাই আকর্ষণীয় ছিলেন যে, সম্ভবত কোনো খল চরিত্রেও ঠিক খাপ খেতেন না। তুখোড় অভিনেতা ওমর শরীফকে নিয়ে হলিউড অনেকটা এমনই ভড়কে গিয়েছিল। অথচ পশ্চিমা নির্মাতাদের রুচি আর কল্পনাশক্তি থাকলেই ওমর শরিফ এমনকি দুর্দান্ত এক জেমস বন্ড নায়কও হতে পারতেন। এমন মনে করেন চলচ্চিত্র সমালোচক পিটার ব্র্যাডশ।
লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার মরু দিগন্ত থেকে উঠে আসা কল্পকাহিনির মতোই বিস্ময়কর ওমর শরিফ। তিনি সুদর্শন, অভিজ্ঞ এবং যেন চুরুট-টানা ধোঁয়ায় চারপাশ মোহিত করে রাখার মতো অত্যন্ত পুরুষালি আর সত্যিকারের সুন্দর।
শরিফ প্রথাগত আর দশজন আইডলের মতো নন। তাঁর স্বভাবগম্ভীর চাহনি আর ভিনদেশি গ্ল্যামারই তাঁকে ষাটের দশকের হলিউডে নিয়ে এসেছিল। একটু আগের প্রজন্মের কাছে যেমন ছিলেন ফরাসি অভিনেতা শার্ল বোইয়ে। তিনি ছিলেন রুচিমান, আন্তর্জাতিকভাবে পরিশীলিত এক অভিজাততন্ত্রের অংশ। প্রত্যয়ী কিন্তু খানিকটা রক্ষণশীল, এমন এক স্টাইল যা ওমর শরিফের বিপুল তারকা খ্যাতি অর্জনের কালেই হয়তো কিছুটা সেকেলে হয়ে উঠছিল।
কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলা নিয়ে শরিফের পেশাদার অনুরাগ আর তাঁর ক্যাসিনো জীবন তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সমান্তরালে চালিয়ে গেছেন। এটা তাঁকে তুখোড় জুয়াড়ির আকর্ষণীয় চরিত্র আর নগর-সেরা পুরুষের অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিল। সেকালের প্রযোজকেরা যদি চরিত্র নির্বাচনে আরেকটু সাহসী হতেন তাহলে হয়তো ওমর শরিফই জেমস বন্ড সিরিজের দারুণ একটা ছবি উপহার দিতে পারতেন।
ওমর শরিফের মহা সাফল্য এসেছিল ডেভিড লিনের হাত ধরে। তিনিই তাঁকে তারকা বানিয়ে দিয়েছিলেন দুই মহাকাব্যিক ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দিয়ে— “লরেন্স অব অ্যারাবিয়া” (১৯৬২) এবং “ডক্টর জিভাগো” (১৯৬৫)। এগুলো এমন সাফল্য- যা কেবল লিনের পক্ষেই সম্ভব। লিন শরিফের চরিত্রে একটা প্রাচ্যদেশীয় ক্যারিশমা আরোপ করেন এবং তাঁকে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অভিষেকের সুযোগ করে দেন।
“লরেন্স অব অ্যারাবিয়া”য় ওমর শরিফের চরিত্রের নাম ছিল শরিফ আলী, লরেন্স চরিত্রে পিটার ও’টুলের বন্ধু হয়ে ওঠা আরব গোত্রপতি। রহস্যঘেরা মরুভূমিতে চমকপ্রদ সব অভিযাত্রায় টানা ক্যামেরা চালিয়ে যাওয়া সব দৃশ্যে শরিফ যেন প্রকৃতির শক্তির মতোই হাজির ছিলেন এই ছবিতে। শরিফ যদি এতটা আকর্ষণীয় না হতেন কিংবা আর একটু কম স্টাইলিশ হতেন তাহলে এই ছবির বাকি অংশে তাঁর যে কাজ তা মাঠে মারা যেতে পারতো। কিন্তু সেটা হয়নি। যদিও তিনি এখানে বরাবরই সাড়া জাগানো নবাগত অভিনেতা পিটার ও’টুলের চরিত্রের পার্শ্বচরিত্র হিসেবেই ছিলেন।
“ডক্টর জিভাগো”তে কেন্দ্রীয় চরিত্রে চলে এলেন ওমর শরিফ। লরেন্সে না থাকলেও এই ছবিতে নারী চরিত্র ছিল। আর শরিফের মিসরীয় বৈশিষ্ট্যই যেন এখানকার রুশ চরিত্রে মানিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে প্রয়োজনীয় রসদ জুগিয়েছিল।
জুলি ক্রিস্টি আর ওমর শরিফ মিলে দারুণ এক জুটি হয়েছিলেন। অবশ্য এই ছবির আবেগী প্রেম আর খানিকটা মিল থাকার কারণে অনেকে একে প্রাচ্যের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ বলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু পাস্তেরনাকের “ডক্টর জিভাগো” উপন্যাসটি রাশিয়ায় তখনো নিষিদ্ধ থাকায় এবং যুক্তরাষ্ট্র- সোভিয়েত রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই এ ছবির মুক্তি হওয়ায় তা তুমুল সাড়া জাগিয়েছিল।
হলিউডের ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্রে আসার আগেই শরিফ মিসরীয় চলচ্চিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত আর তুখোড় শরিফ ছিলেন দুর্দান্ত স্টাইলিশ— এমন এক পুরুষ; যার জন্মই হয়েছে মুভি ক্যামেরায় ধরা পড়ার জন্য।
চলচ্চিত্র কি জিনিস মাথায় ছিল না কখনো; কিন্তু ইউরোপে পড়াশোনা করার ফলে একদিন অভিনয়ের নেশা ঢুকে যায় মাথার ভেতর। তারপরও বিষয়টি এতো সিরিয়াসলি নেননি তিনি। গণিত আর পদার্থবিদ্যায় জ্ঞান অর্জন করে কীভাবে একজন মানুষ অভিনয়ের প্যাশন মাথায় বহন করে ঘুরে বেড়ায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারেন মিশরিয় অভিনেতা এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রে এক প্রাজ্ঞজন ওমর শরিফ।
ওমর শরিফ, শুধু একজন মিশরীয় অভিনেতাই নন, বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক প্রভাবশালী অভিনেতাও বটে। অভিনয়ের ঝোঁক থেকে হঠাৎ একদিন রিয়েল লাইফ থেকে রিল লাইফে ঢুকে পড়েন অভিনয় সাম্রাজ্যের এই মহান পুরুষ। তার আগে অভিনয়ের ওপর পড়াশোনাও করেন তিনি। লন্ডনে নাট্যকলার ওপর পড়ালেখা করে নিজভূম মিশরে ফেরেন। ১৯৫৪ সালে মিশরীয় ‘শাইতান আল সাহারা’ মানে ‘ডেভিল অব দ্য ডেজার্ট’ নামের ছবিতে প্রথম অভিনয়ও করেন। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে না হলেও নিজের অজান্তেই যেন ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে যায় চলচ্চিত্রের পথে। ছোট্ট চরিত্র, তারপরও তার অভিনয় ক্ষমতায় মুগ্ধ হন স্বয়ং নির্মাতা ইউসুফ চাহিনী। সে বছরেই তাকে আরেকটি সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য কাস্ট করেন ইউসুফ।
ওমর শরিফ ১৯৩২ সালের আজকের দিনে (১০ এপ্রিল) মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।