
বাবলু ভট্টাচার্য
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী প্রখ্যাত সমাজসংস্কারক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি মূলত একজন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবেও পরিচিত তিনি। সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসাবেও তিনি রেখেছেন অনবদ্য অবদান।
১৯৭০ দশকে টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি আলোকিত মানুষ তৈরির কাজে নিয়োজিত ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’।
তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে।
পিতার কর্মসূত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের নানা জায়গায়। শিক্ষা জীবনে তিনি ১৯৫৫ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ, বাগেরহাট (বর্তমান সরকারি পি.সি. কলেজ, বাগেরহাট) থেকে ১৯৫৭ সালে। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক বি.এ. (অনার্স), ও ১৯৬১ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালে তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরি জীবন শুরু করেন। সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন (বর্তমানে ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ)। এই কলেজে তিনি দু’ বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ।
এরপর তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে সেখানে যোগদান করেন। ঢাকা কলেজেই তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল দেশসেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। অধ্যাপক আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান ৷ ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবন তিনি অত্যন্ত উপভোগ করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ঢাকা কলেজে প্রাণবন্ত, সপ্রতিভ, উজ্জ্বল ছাত্রদের পড়ানোর তৃপ্তি, শিক্ষক-জীবনের অনির্বচনীয়তম আস্বাদ ছেড়ে তিনি যেতে চাননি ৷
ক্লাশের সেরা ছাত্রটিকে পড়ানোর চেষ্টা করার চেয়ে তিনি পড়াতে চেষ্টা করতেন ক্লাশের সবচেয়ে বোকা ছাত্রটিকে৷ সারাক্ষণ তাকেই বোঝাবার চেষ্টা করতেন, কেননা তার বোঝা মানে ক্লাসের বাকি সবার বোঝা।
তিনি একজন সুবক্তা। বাংলাদেশে টেলিভিশনের সূচনালগ্ন থেকে মনস্বী, রুচিমান ও বিনোদন-সক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভুত হন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। টেলিভিশনের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় তিনি পথিকৃৎ ও অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব।
ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, তিনি ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা “কণ্ঠস্বর” কসম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়েই দেননি, সাহিত্য বেগবান করেছেন এক দশক ধরে।
তরুণ বয়সে তিনি কবিতা ও কল্পকাহিনী লিখতেন। অধ্যাপক সায়ীদ বহু প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা লিখেছেন।
আমাদের এই পথনির্দেশক অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পুরস্কার হলো, ১৯৭৭ সালে পেয়েছেন ‘জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার’ , ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন মাহবুব উল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার; ১৯৯৯ সালে পেয়েছেন রোটারি সিড পুরস্কার; ২০০০ সালে পেয়েছেন বাংলাদেশ বুক ক্লাব পুরস্কার। ২০০৫ সালে একুশে পদক পান। ২০০৪ সালে তিনি র্যামন মাগাসেসে পুরস্কার অর্জন করেন এবং ২০১২ সলে বাংলা একাডেমী পুরষ্কারে ভূষিত হন।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যক্তিত্বের সবগুলো দিক সমন্বিত হয়েছে তাঁর “বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের” সংগঠক সত্তায়। তিনি অনুভব করেছেন যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ। তাই দেশের আদর্শগত অবক্ষয় দেখে তা থেকে উত্তরণের জন্যে অধ্যাপক সায়ীদ ১৯৭৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তোলেন। “আলোকিত মানুষ চাই”- সারা দেশে এই আন্দোলনের অগ্রযাত্রী হিসেবে প্রায় তিন দশক ধরে তিনি রয়েছেন সংগ্রামশীল। একজন মানুষ যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অধ্যয়ন, মূল্যবোধের চর্চা এবং মানবসভ্যতার যা-কিছু শ্রেয় ও মহান তার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠতে পারে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তেমনই এটি সর্বাঙ্গীণ জীবন-পরিবেশ।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমের পাশাপাশি স্যার জড়িত আছেন পরিবেশ দূষণবিরোধী আন্দোলনে, ডেঙ্গু প্রতিরোধ আন্দোলনে এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের আশাবাদ নিয়ে জড়িত হয়েছেন ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ এর একজন ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য হিসাবে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৩৯ সালের আজকের দিনে (২৫ জুলাই) কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন।
ছবি: গুগল