বইটি লিখেছেন ভারতীয় লেখক শ্রাবণী বসু, নাম-ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আবদুল। সেই বইয়ের কাহিনি নিয়ে বৃটিশ চিলচ্চিত্র পরিচালক স্টিফেন ফ্রিয়ার্স তৈরী করে ফেলেছেন সিনেমা। এই ভিক্টোরিয়া কিন্তু যেনতেন নারী নন, তিনি হলেন ইংল্যান্ডের সেই প্রবল প্রতাপশালী কুইন ভিক্টোরিয়া আর আবদুল করিম তাঁরই ভারতীয় ভৃত্য। কিন্তু আবদুল করিম কি শুধুই ভৃত্য ছিলেন? উপন্যাসের কাহিনি কিন্তু তা বলে না। শ্রাবণী বসু তার এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে উইন্ডসর কাস্ল-এ বসে পড়েছেন ভিক্টোরিয়ার জার্নাল— ‘হিন্দুস্তানি জার্নাল’। দেখেছেন রানির বিশ্রামভবন অসবর্ন হাউসের ইন্ডিয়া করিডরে ঝোলানো সেই করিমের ছবি। ভারত থেকে যাওয়া এই করিম খুব অল্প সময়ে রানীর কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। এসব নিয়ে কথা উঠেছিল তখনকার ইংল্যান্ডের রাজদরবারেও। চার বছর ধরে নানা গল্পের টুকরো জোড়া দিয়েই শ্রাবণী বসু লিখে ফেললেন ‘ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আবদুল’।
এই কাহিনি অবলম্বনে ছবিটি ইংল্যান্ডের প্রেক্ষাগৃহে ইতিমধ্যে প্রদর্শিত হচ্ছে। আমেরিকার দর্শকরা সিনেমাটি দেখতে পাবেন আগামী ২২ সেপ্টেম্বর। প্রায় একই সময়ে ভারতেও মুক্তি পাবে এই ছবি।
আবদুল করিম একা নন তার সঙ্গে ভারত থেকে নেয়া হয়েছিলো আরেকজন ভৃত্য। তার নাম মুহাম্মদ বকস। কিন্তু আবদুল করিমই রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। ছবিতে রাণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী জুডি ডেঞ্চ। দুই ভারতীয় ভৃত্যের ভূমিকায় রয়েছেন আলি ফজল আর আদিল আখতার। ইংল্যান্ডের গ্রিনউইচে রয়্যাল নেভাল কলেজ ও অসবর্ন হাউসের ‘দরবার হল’, ইন্ডিয়ান করিডরে ছবির শুটিং হয়েছিল।বিশাল হল ঘরটিকে সাজিয়ে নেয়া হয় সেই সময়ের রাণীর রাজপ্রাসাদের চেহারায়। ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন লি হল, অভিনয় করেছেন ব্রিটিশ অভিনেতারা— মাইকেল গ্যাম্বন, টিম পিগট স্মিথ, সিমন ক্যালো, এডি ইজার্ড। আবদুল করিমের চরিত্রে অভিনয় করবেন বলিউড-অভিনেতা আলি ফজল।

আবদুল করিম
করিম আর মুহম্মদের পোশাক তৈরী করতে দুমাসেরও বেশী সময় লেগেছে ৪০ জন পোশাকশিল্পীর। ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে আগরা জেল-এর কারাবন্দি ও পুলিশ অফিসারদের ছবি দেখে লেখকের সহায়তায় পোশাক তৈরি হয়েছে। আগরার একটা কলেজকে কারাগার বানানো হয়েছিল। আগরা জেলে বন্দিদের গালিচা বোনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত, ছবিতেও সেই সব সযত্নে রাখা হয়েছে। গ্রামে গিয়ে অ্যালান পুরনো আমলের তাঁত খুঁজে বার করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিকের আগরার রাস্তাঘাট, ধুলো, গরমের তাত— সব ধরা হয়েছে অপূর্ব রঙে, রূপে। ছাদের উপর দিয়ে দেখা যেত তাজমহলকে। এখানেই এক ভোরে আবদুল করিমের গল্প শুরু হয়েছিল।

শিল্পীর তুলিতে ভিক্টোরিয়া ও আবদুল
রানির বিশ্রামভবন অসবর্ন হাউসের ইন্ডিয়া করিডরে ঝোলানো একটা ছবিতে আবদুল করিমকে দেখে শ্রাবণী বসুর অন্য ধরণের অনুভূতি তৈরী হয়েছিলো। গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। আর সেদিন থেকেই এ বিষয়ে কিছু লেখার চিন্তা তার মাথায় আসে। সেই ছবিটা এঁকেছিলেন অস্ট্রিয়ান শিল্পী রুডল্ফ সোবোদা। সেখানে করিম এক সুদর্শন তরুণ, হাতে একটা বই, চোখের দৃষ্টি আনমনা। তাঁকে দেখে ভৃত্য একেবারেই নয়, নবাব বলে মনে হয়। অসবর্নে ভিক্টোরিয়ার ড্রেসিং রুমে রানির স্কটিশ শিকার-অনুচর জন ব্রাউন আর আবদুল করিমের ছবি উপর-নিচে ঝোলানো আছে। গাইড লেখককে জানিয়েছিলো, স্বয়ং রানি ওগুলো দেওয়ালে টাঙিয়ে গিয়েছেন।
শ্রাবণী বসু বলেন, ‘খুব কম জনই জানেন যে বর্ষীয়সী রানি আবদুলের কাছেই উর্দু পড়া, লেখা শিখেছিলেন; তেরো বছর ধরে ডায়েরি লিখেছেন। আশ্চর্যের কথা, এগুলোর কখনওই অনুবাদ হয়নি। পড়তে পড়তে এক অসাধারণ বন্ধুতার সম্পর্ক যেন আমার সামনে খুলে গেল। রানির ডাক্তার, স্যর জেমস রিড-এর ডায়েরি পড়লাম; রাজপ্রাসাদের সদস্যদের, ইন্ডিয়ার ভাইসরয়ের, রানির নিজের চিঠিপত্র পড়লাম। সব কিছু থেকেই একটা জিনিস পরিষ্কার, আবদুল করিমের উপস্থিতি দরবারে বেশ মাথাব্যথারই কারণ হয়েছিল। মনে হল, আরও জানতে হবে ওঁকে নিয়ে। আগরা যেতে হবে, যেখানে ওঁর বাড়ি ছিল।’
লেখক আবদুল করিমের কবর অনেক সন্ধান করে খুঁজে পেয়েছিলেন আগ্রায়। তাতে ‘রানির মুনসি ও শিক্ষক’-এর নামে প্রশস্তিবাক্য লেখা। যত সম্মান আর খেতাব পেয়েছিলেন, তার তালিকাও দেয়া।বইয়ের মতোই, ছবির শুরুও ১৮৮৭ সালে, যে বছর ভিক্টোরিয়া তাঁর শাসনামলের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ উদ্যাপন করছেন। তাঁর সাম্রাজ্য তখন খ্যাতি ও সমৃদ্ধির শীর্ষে, পৃথিবীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ জুড়ে তার বিস্তৃতি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন, এই উৎসবে কিছু ভারতীয় ‘প্রিন্স’কে আমন্ত্রণ জানালে বেশ ভাল হয়। রানির পার্টিতে সারা বিশ্বের সামনে সাম্রাজ্যের রবরবা তুলে ধরা যাবে।

লন্ডনের রাস্তায় চলছে ছবির প্রচারণা
রানি এক বার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, ভৃত্যদের মধ্যে কয়েক জন ভারতীয় হলে বেশ হত। সে জন্যই আবদুল করিম ও মুহাম্মদ বক্সকে রানির কাছে পাঠানো হয়, ‘জুবিলি উপহার’ হিসেবে। তাঁদের কাজ ছিল খাওয়ার টেবিলে রানির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রয়োজনমতো কাজকর্ম করা।

রাণী ও আবদুলের ছবি
লাল পোশাক আর সাদা পাগড়ি পরা তরুণ সুদর্শন করিমকে রানির ভাল লেগেছিল। প্রথামাফিক রানিকে অভিবাদন জানিয়ে করিম তাঁকে একটি সোনার মোহর নজরানা দেন। রানি জানতেন, বছর চব্বিশের তরুণটি এসেছেন আগরা, তাজমহল-এর দেশ থেকে। রানি এটুকুতে খুশি নন, জানতে চান আরও। করিমকে ইংরেজি শেখানোর নির্দেশ দিলেন, তাঁর সঙ্গে আরও কথা বলবেন। করিম রানিকে তাঁর চিঠি লেখার কাজে সাহায্য করতে শুরু করলেন। রানি সই করছেন চিঠিতে, করিম দাঁড়িয়ে আছেন পিছনে বা পাশে— শান্ত, ধীরস্থির। রানির খুব ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষা শেখার ইচ্ছে, করিম তাঁকে দিলেন ছোট্ট একটা পকেট-বই, ভাষা শেখার। রানি সব সময় সেটি নিয়ে ঘুরতেন। এর পরেই তাঁর তেরো খণ্ডের ‘হিন্দুস্তানি জার্নাল’-এর প্রথম খণ্ডটি শুরু।
এক দিন রানির রন্ধনশালায় করিম তাঁর মশলার বাক্স নিয়ে হাজির। রানির জন্য ‘কারি’ রান্না করলেন। করিমের কারি রানির মন জয় করল। ভিক্টোরিয়া বললেন, রোজ এই খাবার তাঁর লাঞ্চে চাই। চিকেন কারি আর ডাল খুব প্রিয় ছিল তাঁর।
করিমের মুখে আগরা শহর আর তাজমহলের গল্প শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যেতেন ভিক্টোরিয়া। গল্প শুনতে শুনতে মুঘল সাম্রাজ্যের দিনগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠত ভিক্টোরিয়ার চোখের সামনে।
দরবারে আসার এক বছরের মধ্যেই করিমের প্রোমোশন হল। রানি তাঁকে ‘ইন্ডিয়ান সেক্রেটারি’ করলেন, ‘মুনসি’ খেতাব দিলেন। খাওয়ার টেবিলে রানির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা করিমের ছবিগুলো সব নষ্ট করে ফেলতে বললেন। সবাইকে ডেকে বললেন, করিমকে এখন থেকে ‘মুনসি’ সম্বোধন করতে। রাজপ্রাসাদে সবার এ জিনিস সহ্য করা মুশকিল ছিল।

সিনেমার পোস্টার
করিমের বিরুদ্ধে ফন্দি আঁটতে লাগল অনেকে। প্রচার শুরু হল, করিম আসলে গুপ্তচর, মুসলিম পেট্রিয়টিক লিগ-এর সঙ্গে যুক্ত, ব্রিটিশবিরোধী। এও রটাল, করিম চোর। ভারতে ফেরার পরও করিমের পিছনে ফেউ লেগেছিল।
১৮৯৭ সালে, রানির সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এই সব ষড়যন্ত্র তুঙ্গে উঠল। সারা বিশ্ব যখন রানির বৈভব আর সমৃদ্ধি দেখে মুগ্ধ, ঠিক তখনই মুনসিকে কেন্দ্র করে রাজদরবার হয়ে উঠেছিল একটা ফুটন্ত কড়াই। এমনকী সবাই গণ-পদত্যাগের হুমকিও দিল। রানিকে কিন্তু কিছুতেই টলানো যায়নি। প্রিয় মুনসির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বরং পরিবার ও প্রাসাদের বাকি সদস্যদের উদ্দেশে একটা কড়া নোটিস পাঠালেন। সবাইকে বললেন মুনসিকে সম্মান করতে। ভেবেছিলেন তাঁকে নাইটহুডও দেবেন, পরে মত পরিবর্তন করে তাঁকে এমভিও (মেম্বার অব দ্য ভিক্টোরিয়ান অর্ডার) উপাধি দেন।

করিমের ভূমিকায় আলি আফজাল
ভিক্টোরিয়ার শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল, তাতে কী, মন এখনও দৃঢ়। ১৮৯৯-এর নভেম্বরে তিনি হিন্দুস্তানি জার্নালে শেষ লেখাটি লিখলেন। তার দু’মাস পর, অসবর্নেই শান্তির মৃত্যু এল। কফিন বন্ধ করার আগে, শেষ যে মানুষটি তাঁকে দেখতে এলেন, তিনি আবদুল করিম। বন্ধুর জন্য প্রার্থনায় ঠোঁটদু’টো নিঃশব্দে নড়ছে।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত এবং দ্রুত। রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড বদলা নিলেন। সব চিঠিপত্র নষ্ট করে ফেলা হল, করিমকে ফেরত পাঠানো হল দেশে। অন্য ভারতীয় ভৃত্যদেরও চাকরি গেল। দরবারে পাগড়ি দেখা যায় না, পাকশালায় কারি রান্না বন্ধ।
১৯০১ সালে আবদুল করিম আগরায় ফিরে আসেন। তখন তিনি এক ভগ্নহৃদয় মানুষ। আট বছর পর ১৯০৯ সালে, নিজের শহরেই মারা যান তিনি, মাত্র ৪৬ বছর বয়সে। ভিক্টোরিয়ার কাছের মানুষ, প্রিয় বন্ধুকে ভুলে গেল ইতিহাস। পড়ে রইল কেবল আগ্রার এক হতশ্রী কবরস্থানে মানুষটির সমাধি।
প্রাণের বাংলা ডেস্ক
তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা
ছবিঃ গুগল