
শিলা চৌধুরী
পরন্ত বিকেল থেকেই ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে আছে।মেঘের রেষারেষিতে চোখ ঝলসে দেয়া বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে গর্জন।মেঘের এতো হুমকি স্বত্বেও বৃষ্টি হচ্ছে ছিটেফোঁটা।তপ্ত বৈশাখের রোদে পোড়া মাটিতে একটু জলের পরশ লাগতেই ভেজা মাটির মাতাল করা সোঁদা গন্ধে ঘরে টিকতে না পেরে বারান্দায় দাঁড়ালাম।প্রকৃতির এই উপহার ফরাসী সুগন্ধীর চেয়ে ও অনেক বেশি দামী।চোখ বন্ধ করে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে মাতাল হয়ে নিতে লাগলাম সেই সুগন্ধির আস্বাদন।চড়ুই পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে মাতাল হাওয়া থেকে মুখ ফেরালাম।বেশ কদিন ধরে একটা দলছুট চড়ুই পাখি বারান্দায় কাপড় শুকানোর রশিতে রাত্রিযাপন করছে।ছোট্ট দুটি নির্ভীক চোখে বারান্দায় গেলেই পিটপিট করে তাকিয়ে থাকবে।হয়তোবা সে বুঝতে পেরে গিয়েছে এখানেই তার নিরাপদ আশ্রয়।ছোট্ট এই পাখিটার সং্ একলা মুহূর্তে প্রায়ই কথা বলি।জানতে চাই কোথা থেকে এসেছে, কি জানি ওরা মানুষের ভাষা বুঝতে পারে কিনা, ঘাড় নেড়ে নেড়ে অপলকে তাকিয়ে থাকে কথা বলার মুহূর্তে ।
দলছুট এই পাখিটার সাথে কথা বলার সময়ে আজ কেন জানি না মনে পড়ে গেল মিতালী বৌদির মুখটা।প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে সারাক্ষণ বসে থাকবেন নিজের ভারী শরীরের বোঝা নিয়ে আর মুখে চিবোবেন পান মসলা।শত আনন্দ, আড্ডার মাঝেও বসে থাকেন নিশ্চুপ শ্রোতা হয়ে।ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায় আড্ডা চলাকালীন সময়ে ওনার বুক ফাটা দীর্ঘশ্বাসটাকে।ভাবলেশহীন চোখে মাঝে মাঝেই তাকান ডিভানে হেলান দেয়া স্বামীর দিকে।গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না সেই চাহনীর অর্থ।ঘৃণা, ক্ষোভ, না পাওয়ার যন্ত্রণায় ভরা সেই চহনী,কিছুটা ভালোবাসার ছোঁয়াও পাওয়া যায় মাঝে মাঝে।
কদিন আগে বৌদিদের ঘরে উঁকি দিতেই দেখি একটা অ্যালবামের পাতা উল্টাচ্ছেন আর মুচকি হাসছেন। অনেকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু অ্যালবামের পাতা থেকে কিছুতেই বৌদির চোখ ফিরছেনা দরজায় ।শেষ পর্যন্ত অনেকটা কৌতুহলেই ওনার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আলতো করে কাঁধে হাত দিতেই বলে উঠলো….দেখতো চিনতে পারো একে।সত্যিই চিনতে পারলাম না ।ছিপছিপে লাস্যময়ী এক তরুণী সাদাকালো ছবির ফ্রেমে । অ্যালবামের একটা করে পাতা উল্টাচ্ছেন আর সেই সাথে ছুটে চলেছে ওনার দীর্ঘদিনের জমে থাকা কথার ফুলঝুরি।যখন কোন শিশু নতুন কথা শেখার পর তরতর করে বলে যায় তার কথার মালা।বৌদি যেন হঠাৎ করেই সেই শিশু হয়ে গিয়েছেন।চিনতে বা হয়তোবা বুঝতে পারছি না এমন ভাব করে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম হাঁ করে ।উনি বলে চললেন…..পাহাড়ের কোল ঘেঁষা আসামের ডিব্রুগড়ে মামা বাড়িতে বড় দু বোনের পরে জন্ম।বাবার আদি বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর।দেশ ভাগের সময় চলে আসেন আগরতলায়।বৌদির মায়ের যখন তেরো বছর তখন বিয়ে হয়।”ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে “যেমন ঠিক তেমনি বৌদির মায়ের বিয়ে।ছাদনাতলায় বর বসে।বিয়ে বৌদির বড় বোনের।বৌদির বড় বোন ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা আর সেই সাথে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।অনেক বেশি স্বাধীনচেতা ছিলেন বৌদির সেই মাসি।কনের সাজ খুলে বেকে বসলেন বিয়ে ককরবেন না বলে।তখন শুরু হয়ে যায় বাড়িতে মরা কান্না।ইজ্জত বাঁচাতে ছোট তেরো বছরের বোনকে ধরে এনে কনে সাজিয়ে বিয়ের পড়িতে।
ছোট্ট সেই তেরো বছরের মেয়েটি পুতুল হাতে নিয়ে শ্বশুরবাড়ী যান কিছু না বুঝেই বয়সে দ্দ্বিগুনের বেশি বয়সের বরের সাথে।দিন যায়. …..হাত থেকে নিজের অজান্তেই টিনের বাক্সে উঠে যায় সেই খেলার পুতুল শ্বাশুড়ীর নিষ্ঠুর অত্যাচারে ।প্রথম মেয়ে জন্মের পর থেকে তা আরো বেড়ে যায়।সেটা ভয়ঙ্কর অত্যাচারে পৌঁছায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়ে জন্মের পর।তিন কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে শাস্তি হিসেবে শ্বাশুড়ী অকথ্য নির্যাতন আর অপবাদ দিয়ে তিন সন্তান সহ বাড়ি থেকে বের করে দেয়।রেলওয়েতে চাকরী করা বর কোন প্রতিবাদই করেনি মায়ের এই নারকীয় সিদ্ধান্তের।
ভালো করে সংসার বুঝার আগেই স্বামী শ্বশুরবাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে তিন মেয়েকে নিয়ে বাবার আশ্রয়ে থেকে শুরু হয় অমানবিক লড়াইয়ের জীবন।তিন মেয়ে যখন আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছিল তখন বাবার আশ্রয় ও অনেক বেশি অচেনা আর দূরে সরে যাচ্ছিলো।বৌদির মায়ের দূর সম্পর্কের এক ভাই একদিন আসাম গিয়ে ওনাদের দুর্দশা দেখে কলকাতা নিয়ে আসেন মা সহ তিন মেয়েকে।কিন্তু তখনও ওনাদের সহজ সরল মন অজানায় ছিল যে কেউ কখনো স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ দেন না।মামী,মামাতো ভাইবোনদের অত্যাচার আর পুরো সংসারের কাজ করার পাশাপাশি তিন বোনই স্কুলে যাওয়া শুরু করে।মামা সহানুভূতিশীল ছিলেন যথেষ্ট।গোপনে ভাগ্নীদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করে আসছিলেন ।টালির খুপরি মতো ভাড়া বাড়িতে গায়ের উপর গা লেগে থাকতো এমনভাবে রাতযাপন ছিল মা ও তিন বোনের নিত্যসঙ্গী।আশ্রয়দাতা মামার সন্তানদের একে একে বিয়ে হয়ে নিজেদের আলাদা সংসার হয়।মামা ও ভাগ্নীদের নিয়ে টালিগঞ্জের রানীকুঠীতে আবাস বদল করে চলে আসেন।ওদের জীবনে ও নতুন স্বপ্ন আর সুখের কিছুটা ছোঁয়া লাগে।তাও ক্ষনিকের।বড় দুবোনের বিয়ে হয়ে যাবার পর বিয়ের পালা আসে মিতালী বৌদির।
দু ননদ আর বিধবা শ্বাশুড়ীর সাথে আবার আরেক অধ্যায়ের শুরু করেন স্বামীর সংসারে মিতালী বৌদি।স্বামীর যখন চার বছর বয়স তখন চাকরীজীবি বাবাকে হারান।এমনিতে যথেষ্ট সচ্ছল পরিবার ছিল।টালির ঘরে এগারোখানা ভাড়াটিয়া ছিল ।মৃত শ্বশুরমশাইয়ের চাকুরিটা পান শ্বাশুড়ী।রোজগেরে শ্বাশুড়ী
এতো বেশি অত্যাচারী ছিলেন যে ভাড়াটিয়ার সাথে কথা বলার অপরাধে নিজের মেয়ের হাত ব্লেড দিয়ে কেটে গরম জলে লবণ মরিচ মিশিয়ে ঢেলে দিতেন ওই কাটা জায়গায়।শুধু তাতেই থেমে থাকেনি সেই অত্যাচারের সীমা।জেলখানার হিংস্র কয়েদীদের যেমিন লোহার ডান্ডা বেড়ি পরিয়ে রাখা হয় তেমনি বানিয়ে নিয়েছিলেন মেয়ে আর ছেলের বউয়ের জন্যে।আর পান থেকে চুন খসলেই গয়নার জায়গায় ডান্ডা বেড়ি পরা ছিল নিত্যসঙ্গী।
শুধু শ্বাশুড়ীর অত্যাচারেই থেমে থাকলে কথা ছিল না।বিয়ের পর নতুন বৌয়ের বুঝতে একদিন সময় লাগেনি স্বামীর গূনের ঠাহর করতে।স্বামী শুধুমাত্র মদ্যপানে অভ্যস্ত থাকলেও চলতো মিতালী বৌদির, কিন্তু না এতেও জোর ধাক্কা খেলেন।হাতে গুনে শেষ করা যাবে না এতসব মেয়ের সাথে প্রেমেই থেমে থাকেনি সম্পর্ক।শারীরিক সম্পর্ক তো ছিলই ওই মেয়েদের সাথে আর অবাধ যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ পল্লীতে।আর এহেন গুনাগুন যে একমাত্র ছেলের ছিল শ্বাশুড়ী সব জানতেন আর সেসব গুন অর্জন ও করেছেন শ্বাশুড়ীর অতিরিক্ত আদর আর না দেখার ভান করে চোখ বুজে থাকার কারণে। ঐযে কন্যা নয় পুত্র সন্তান তাও আবার একমাত্র পুত্র।মেয়ে আর ছেলের বউয়ের প্রতি যত বেশি নিষ্ঠুর ,অত্যাচারী ছিলেন ছেলের প্রতি ছিলেন তার ঠিক বিপরীতের চেয়েও আদর আর প্রশ্রয়।
প্রতি সেকেন্ড ভয়ে জর্জরিত হয়ে গুটিয়ে থাকতেন শ্বাশুড়ীর অত্যাচারে আর মধ্যরাতে মদ্যপ স্বামীর লীলা শেষে ঘরে ফেরার অপেক্ষায়।খাঁচায় পোষা পাখির যেমন ডানা মেলে উড়ার ক্ষমতা বা সাহস থাকে না খাঁচার বাইরে যাবার তেমনি স্তব্ধ আর বোবায় পরিনত হয়ে যেতে শুরু করেন মিতালী বৌদি।এর মধ্যে তপ্ত দুপুরে দমকা হাওয়ার মতো এক টুকরো সুখ বৌদির জীবনে কিছুটা পরিবর্তন আনে।প্রথম সন্তান পুত্র হওয়ায় সেই অন্ধকার জগতের থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে ।লক্ষী বৌমার আদর ও জোটে খানিকটা শুধুমাত্র পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তাই।একজন মানুষ,তার ও স্বপ্ন সাধ,নিজস্ব কিছু চাওয়া,চাহিদা থাকে যা একান্তই নিজস্ব সেটা শ্বাশুড়ী যিনি নিজেও একজন মেয়ে, মা,একটা সময় বৌমা ও ছিলেন তিনিই কি করে এতো বেশি নিষ্ঠুর হতে পারেন নিজের জন্ম দেয়া কন্যার সাথে আর বৌমার সাথে।ওনার সে উপলব্ধি আর বোধোদয় হওয়ার আগেই একদিন চাকরিরত অবস্থায় মারা যান হঠাৎ করেই।
শোক আর কিছুটা খোলা আকাশের স্বপ্নে বিভোর মিতালী বৌদির আবার এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।একা হাতে পুরো সংসারের যাবতীয় কাজ, বড় ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া আবার আনতে যাওয়া, ছোট ছেলের যত্ন,সেই সাথে ছোট ছেলে জন্মের সময় সার্জারির জায়গায় পচন ধরে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসা,শারীরিক ভাবে অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়া মিতালী বৌদির কপালে জোটে স্বামীর মুদিখানা আর টেলিফোন বুথ সামলানোর দায়।বোবা তো হয়েই ছিলেন আগেই তার সাথে শুরু হয় যন্ত্রের মতো দিনরাত ছুটে চলা জীবনের।একজন মানুষ তার নিজস্ব চাওয়া, ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন আর সেই ছোট্ট স্বপ্নকে ও ছুঁতে না পারার ব্যর্থতা, ।ক্ষতবিক্ষত মনের যন্ত্রণা আগরতলা থেকে আসাম,আসাম থেকে কলকাতায় মামার আশ্রয় আর একজন মেয়ের আজন্ম অধিকার ও চাওয়া স্বামী আর তার সংসার, সেই সংসারের ছোট ছোট সুখানুভূতি,স্বামীর ভালোবাসা, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত এই সামান্যতম চাওয়ার থেকে অদূরে থাকা মিতালী বৌদি।
থেমে নেই এরপরে ও বৌদির বুক ক্ষতবিক্ষত হওয়ার।বড় ছেলে কৈশোর বয়সেই একজন ডান্স বার নর্তকীকে বিয়ে করে হাজির হয় বৌদিদের সদ্য করা ফ্ল্যাট বাড়িতে।বৌদির স্বামী বাড়িতে ওদের ঢুকতে দেয়নি।।মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন বৌদি এই ঘটনায় অনেক বেশি।
আদরের বড় ছেলের থেকে জোর ধাক্কা খেয়ে বৌদির বর অনেকটাই বদলে যান।পুরোপুরি ঘর বন্দি হয়ে পড়েন আর ঘরেই মদ্যপান করে যান।বৌদির প্রতিও বদলাতে থাকেন অনেক বেশি আর যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ও হয়ে যান।যে সহানুভূতি আর ভালোবাসার স্বপ্নে বিভোর চোখ একজন মেয়ের স্বামীর সংসারে পা রাখেন যদি সেই সময় কপালে জুটত বৌদির হয়তোবা অন্য রকম হতো বৌদির জীবন । ভালো গান গাইতে জানতো,নাচতে ও,সেলাই ফোড়াই তো জানতেনই।স্বামী যদি একটু থেকে গান বা নাচের উৎসাহ দিতেন হতে পারতেন. …..।কিংবা সেলাইয়ে কোন ভালো প্রশিক্ষণ করতে পারলে ক্ষুদ্র উৎদোক্তা হয়ে আরো দশজন মেয়ের ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণের ভাগীদার।
বর্তমানে অনেক কিছুই রয়েছে বৌদির জীবনে, স্বামীর তিনটে ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল দামী আসবা,বাতানুকূল নিজের শোবার ঘর,সব আছে।নেই শুধু স্বপ্নগুলো,নিজস্ব একফালি আকাশ কেননা অষ্টিও আর্থরাইটিসে জর্জরিত মিতালী বৌদির যে ওঠে বসবার বা খোলা আকাশের নিচে গিয়ে আকাশ দেখবার সে ক্ষমতা নেই আর এখন।
বাহান্ন ইঞ্চির এলইডি টিভির পর্দায় সারাদিন মেগা সিরিয়ালের বৌ শ্বাশুড়ীর লড়াই দেখেও যে স্বস্তি পান না বিস্মৃত হতে নিজের অতীত থেকে।নিজের ফেলে আসা সাধারণ স্বাভাবিক একটা জীবন যেটা প্রতিটা মানুষের ন্যায্য আর জন্মগত অধিকার।কোথাও তো ছিলনা বৌদির জীবনে। স্বাধীনতা আছে অগাধ এখন কিন্তু কি করে পারবেন ডানা মেলে উড়তে….শৈশবের গোল্লাছুট খেলার বয়সেই যে মিতালী বৌদির খোলা আকাশে ওড়বার ডানা দুটোই কেটে রেখে দিয়েছেন ওনার জন্মদাতা পিতা।
কাভার ছবি : শ্যামল বসাক