
নিজামুল হক বিপুল
ছবির মতো এক শহর ভার্সাই…
ফ্রান্সের এক ছোট্ট শহর ভার্সাই। ভার্সাই নগরী। নামটাই না কি চমৎকার। যেমন নাম, তেমন শহর। অপূর্ব সুন্দর। একেবারে ছবির মতো। যেন শিল্পীর সু-নিপূণ হাতের তুলির ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছে অপরূপ এক নগরী। মন জুড়িয়ে যায়। নিঃশ্বাস নেয়া যায় প্রাণভরে। ফ্রান্সের রাজাদের শহর বলে কথা। একেবারেই ছিমছাম। পরিপাটি করে সাজানো। রাস্তঘাটে কোন রকম ঝক্কি ঝামেলা নেই। গাড়ির সংখ্যা একেবারেই কম। আছে শুধু দেশি-বিদেশী পর্যটক, পর্যটক আর পর্যটক। রাস্তার সিগন্যাল বাতিগুলো স্বয়ংক্রিয়। জেব্রা ক্রসিং অতিক্রম করে কোন পদচারি রাস্তা পার না হলেও লালবাতি জ্বলার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যায় গাড়ির চাকা। কি দারুণ সভ্যতা আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। ছবির মতো এই শহর আর শাতো দো ভার্সয়ের রাজ প্রাসাদ ঘুরে দেখতে আমরা রওয়ানা হয়েছিলাম ভার্সাই নগরীর উদ্দেশ্যে। ডিসেম্বর মাস। তীব্র শীত সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উপেক্ষা করে কয়েস মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে খুব সকালে রওয়ানা হলাম ভার্সাই’র পথে। প্যারিস শহরের প্রধান রেল স্টেশন গার্দ দো নর্দ থেকে ট্রেনে চড়লাম আমরা। মাত্র ২০-২২ মিনিটের পথ।

রাজপ্রাসাদের সোনালী রং কারুকাজ মন্ডিত এর প্রধান ফটক
কোন রকম বিরতি ছাড়াই পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের ভার্সাইতে। ছোটবেলায় ইতিহাসের পাতায় এই ভার্সাই নগরীর কথা পড়েছিলাম। তখন থেকেই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আহা একবার যদি ভার্সাই যেতে পারতাম…। সেই ভার্সাই নগরে যখন পা রাখলাম, ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে নয়টা কিংবা দশটা। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে আসতেই প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস। ওভারকোটেও ঠান্ডাকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তাতে কি ভার্সাই পৌঁছে তো আর বসে থাকলে চলবে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘুরে দেখতে হবে শহর আর রাজ প্রাসাদ। শীতের জন্য শহরে লোকজনের উপস্থিতি বলতে শুধুই দেশি-বিদেশী পর্যটক। স্টেশন থেকে বের হয়ে সোজা ও প্রশস্ত এক রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছি। রাস্তার পাশেই নিত্যপণ্যের বাজার। বাজার পার হয়ে রাস্তার পাশে একটি কফি শপে ঢুকলাম আমরা। উদ্দেশ্যে কফির পেয়ালায় চুমুক দেয়া। ছোট্ট কাপ। তাতে ক্যাপুচিনো কফি। আমরা দুইজন দুই পেয়ালা নিয়ে শরীর গরম করার চেষ্টা করলাম। কফি শেষ করে আবারো সোজা পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার দুই পাশে সবুজ বৃক্ষের সমারোহ। তবে বেশির ভাগেরই পাতা ঝড়ে গেছে। ভার্সাইয়ের আকাশে সূর্যের দেখা নেই। তবে আকাশ কিছুটা ঝক্ঝক্। মিনিট কয়েক হাঁটার পরই দেখা মিললো বিশাল রাজপ্রাসাদের। প্রাসাদের সামনে বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা। পর্যটকরা সেখানে দল বেঁধে ঘুরছেন। ছবি তুলছেন। আমরাও এগিযে গেলাম সামনের দিকে। প্রাসাদের প্রধান ফটকের দিকে।

ভার্সাই রেল স্টেশন থেকে বের হয়েই দেখা মিলবে এমন তাজা ফুলের দোকানের
ফটকে পৌঁছেই একটা ধাক্কা খেলাম। প্রাসাদ বন্ধ। টিকেট কাউন্টারও বন্ধ। প্রাসাদের আজ ছুটির দিন। অগত্যা কি আর করা। সময় নষ্ট না করে আমরা প্রাসাদের বাইরের দিক ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছবি উঠালাম। ভার্সাইয়ের এই রাজপ্রাসাদ গড়ে উঠেছে ফরাসী ত্রয়োদশ সম্রাট লুই এর সময়ে। লুই সর্বপ্রথম ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে ইট ও পাথর দিয়ে ভার্সাইতে একটি হান্টিং লজ নির্মাণ করেন। সেটাই ছিল প্যালেস অব ভার্সাই বা ভার্সাই রাজপ্রাসাদের শুরু। ত্রয়োদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর প্রায় ১৮ বছর এই প্যালেস অব্যবহৃত ছিল। এরপর চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) এটিকে রাজপ্রাসাদে সম্প্রসারণ করেন ১৬৬১-১৬৭৮ এর মধ্যে। প্যালেস অব ভার্সাই পূর্ণতা পায় চতুর্দশ লুইয়ের শাসনামলে। এ কারণে লুই চতুর্দশকে প্যালেস অব ভার্সাই-এর প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। এই প্রাসাদে ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। দুর্ভাগ্যবশঃত ভার্সাইয়ের এর এই সুরম্য প্রাসাদের ভিতর দিক ঘুরে দেখতে না পারলেও বাইরের দৃশ্য দেখে নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে ফিরতে হয়েছে স্বপ্নের শহর থেকে। ভার্সাই রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটক সোনালী রং এর।

ভার্সাই নগরীর রাজ প্রাসাদ। এখােনই থাকেতন ফ্রান্সের ত্রয়োদশ সম্রাট লুই ও পরবর্তী সম্রাটরা
লোহার এই বিশাল ফটকে আছে নানা কারুকার্য। আর একেবারে সামনের বিশাল উম্মুক্ত জায়গায় একেবারেই প্রথম দিকেই একটি চার কোণা বিশিষ্ট খাম্বার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার উপর চতুর্দশ লুই এর বিশাল একটি ভাস্কর্য। মাত্র ঘণ্টা দেড়েক এর ভ্রমণ শেষ করে অপূর্ণতা রেখেই আমরা আবার ছুটলাম শহর প্যারিসের উদ্দেশ্যে। আবারো সেই ট্রেন। ট্রেনে বসে রেল লাইনের দুই পাশের দৃশ্য দেখে মন ভরে উঠছিল। চমৎকার পরিবেশ-প্রতিবেশ। দুই পাশেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। এমন দৃশ্য দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছে গেলাম গার্দ দো নর্দ এ। এর মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে গেল মাত্র ঘণ্টা তিন একের ভার্সাই অভিযান।( চলবে )
ছবি: লেখক