
আন্জুমান রোজী,(কানাডা থেকে)
কবিতা চেতনার কথা বলে, চিন্তার কথা বলে, বলে আবেগ-ভাবনার কথা। কবিতা মানুষ, জীবন, দেশ ও মাটির কথা বলে; বলে মানবতার কথা। কবিতা জাগরণের ভাষা আর দ্রোহশব্দের ভাণ্ডার। কবিতা তীক্ষ্ণ এবং ধারালো অনুভূতির প্রকাশ- যা অন্যকোনো সাহিত্যমাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। কবিতার শক্তি কালজয়ী, কবিতার শক্তি সার্বজনীন। কবিতা কী, কেমন এবং কেন কবিতা আমাকে এতো আলোড়িত করে; এমন ভাবের অবতারণা ঘটছে কবি আমিনুল গণী টিটো’র “ক্ষরণের একতারা” কাব্যগ্রন্থটি পড়ে।
আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় কবি আমিনুল গণী টিটো’র আবির্ভাব। দ্রোহের উত্তাপ বুকে নিয়ে রচনা করে যান একের পর এক কবিতা। যেখানে আছে ক্ষোভ, আক্ষেপ এবং না- পাওয়ার যন্ত্রণা। আছে মৌলবাদী দৌরাত্মের চিত্র, আছে মানবতা ক্ষয়ের রূপ। যে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চিন্তা- চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন হয়েছিল; সেই বাংলাদেশ আজ সাম্প্রদায়িকতার টুপি পরে প্রার্থনারত। এমন বিষমভারে কবির বেদনা উচ্চকিত। কবি কথা বলেন নিজের সঙ্গে নিজে, প্রশ্ন রাখেন নিজ বিবেকের কাছে। কবিতা সেখানে আলোড়ন তোলে শব্দবাক্যে। তারই ভাববিন্যাসে রচিত “ক্ষরণের একতারা” কাব্যগ্রন্থটি। এই কাব্যগ্রন্থটিতে কবির জীবনদর্শন, মানবপ্রেম, ইতিহাস, রাজনীতি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সবকিছুতেই যেন ক্ষরণের আস্ফালন প্রতিফলিত। কী জীবন; কী মানুষ; কী রাজনীতি- সর্বত্রই হতাশার ব্যঞ্জনা। কবি টিটো শব্দমালায় গেঁথেছেন সেই ব্যঞ্জনার ধ্রুপদী সুর। কবি বোঝেন- এই সুর ছুঁয়ে যাবে অন্যকোনো কবিকে। তাই টিটো বলেন,
” প্রত্যেক কবি দলবদ্ধ
প্রত্যেক কবি শুনতে পায়
একে অপরের শব্দ সংকেত”…
তারপরেও কোথায় যেন বিভ্রান্তি। না-বোঝার ভনিতা। সম্পর্কের টানাপোড়ন । এমনি কত ভাবের নিষ্ফল আবেদন। হৃদয়ের ক্ষরণ যেন এভাবেই কবি প্রকাশ করেন,
“যে কোনও সম্পর্কের নামে নিরন্তর বিকিকিনি
মূলত বাজার অর্থনীতি
লাভ-লোকসান ক্ষতি
আশ্রয় সে তো উচ্চ মূল্যের বিলাসিতা
প্রান্তিক কবি যা কখনও আশা করে না
মুঠো-মুঠো ব্যর্থশব্দ ছুড়ে দেই শূন্যে”…
প্রকৃতির নিয়মে আছে মৃত্যু, আছে জন্ম। তাই জন্মমৃত্যুর জীবন পরিক্রমায় কবি ভাবেন,
” আমরা ছায়া মানুষ
কানপেতে রাখি নিরাকার আহ্বানে।”…
যেন কিছুই করার নেই কিছুই বলার নেই। এখানে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে অনাবিল আনন্দ যত।
“ক্ষরণের একতারা” কাব্যগ্রন্থটিতে আরো আছে বিশ্বজিতের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচার না-পাওয়ার আহাজারি। আছে নির্লিপ্ত প্রতিবাদের সুর। আরো আছে রামপালের যন্ত্রণা, খুন, ধর্ষণের নির্মম ঘটনার বর্ণনা। সমগ্র দেশের এক বীভৎস চিত্রের হাহাকার এই কাব্যগ্রন্থে। কী মননে, কী জাগরণে- কবির এমন মর্মবেদনা গভীর করে ছুঁয়ে যায়। কবির কাছে পুরোদেশটি এক বধ্যভুমি। এখানে আর কোনো স্মৃতিসৌধের দরকার নেই। কবি বলেন,
“আমরা প্রেম অহিংসা শান্তি উচ্চারণ করে করে যুদ্ধে লিপ্ত হই।”
আবার কবির কাছে স্বাধীনতা যেন এক স্বপ্নবিলাস। এক ভঙ্গুর মনের অসংলগ্ন সংলাপ। তাই কবি বলেন,
“কেন স্বাধীনতার কথা জিজ্ঞেস করে কাতর করো?
পরিবার থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র সকলেই নির্দয় প্রভু,
কেবল বাণী অধ্যাদেশ,
স্বাধীনতা বলতে বুঝি প্রভুর সদিচ্ছা,
যেখানে তোমার আমার প্রতিফলন নেই।”
জয়বাংলার ধ্বনিও এখন কাতরস্বরে ধ্বনিত হয়। এমন হতাশা থেকে কিছুকথা বলার জন্যে কবির আক্ষেপ প্রকাশ পায় প্রিয় বন্ধুদের উদ্দেশ্যে,
“বন্ধু, কথাগুলো কোথায় লুকাবো?
শরণার্থী গল্প, যশোর রোডের কান্না,
তালি দেয়া শতছিন্ন দুঃখের দিন,
লাঞ্ছিত গর্ভের আর্তনাদ,
রক্তাক্ত অন্ধকার,”…
কবিতার আক্ষরিক অর্থ আজ বেজে উঠছে শতত দামামায়। কবি বলেন, “আলো এবং আঁধারে যেকোনোভাবেই হারাতে থাকে পথ।”…
সত্যি আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। এমন হতাশার করুণ সুর দেখি কবির ভাষায়,
” কড়কড়ে রোদ; তবু কেন দীর্ঘ নিঁখোজ তালিকা
কোথায় দিগদর্শন কম্পাস আশ্চর্য দূরবীন
আর কত অপেক্ষার প্রহর…”
এভাবে অপেক্ষার প্রহর গুনেগুনে; কবি দিন পার করেন। তবুও অপেক্ষা ফুরোয় না। এখানে “কবি এক আজন্ম যোদ্ধা”। সেইসঙ্গে মুক্তচিন্তার ধারকবাহকও হয়ে ওঠেন কবি। কবি ভাবেন, “মুক্তচেতনার কোনো প্রভুর দরকার হয় না।” স্বাধীন চিন্তা-চেতনার মুক্ত প্রকাশ এক সত্যিকার কবির পক্ষেই সম্ভব।
তাই নির্দ্বিধায় আক্ষেপে বলে যান ক্রোধের কথা, দ্রোহের কথা, কখনো-কখনো প্রতিবাদের কথা।
একজন সচেতন নাগরিকের মতো দেশমাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য কবি এঁকে গেছেন নিজ অনুভব। প্রকাশ করেছেন মানবতার কথা, মানুষের কথা। সেইসঙ্গে এঁকেছেন নিজমনের গহীন কোণে লুকিয়ে থাকা প্রেম-বিরহের কথা। তাই-
“প্রিয় নারী বাস করে কোন ঠিকানায়
কেন চমকে ওঠে মন?”
এমন ভাবনায় ভাতঘুম প্রহরে কবি মুহ্যমান হন। কারণ, সে থাকে ভাবনার অন্তরালে, চিরকালের রূপে। এমন ভাবনা কবির সহজিয়া। কবিকে নিয়ে যায় দিগন্তের দিকে। প্রেম, সংঘাত, দ্রোহ, ক্রোধ, ঘাতপ্রতিঘাতের তোয়াক্কা না করে ছুটে যান। এখানে কবি প্রকৃতির সন্তান। তাই তো কবি বলেন,
“আমিও কৈবর্ত থেকে মহাজন
পেছনে ফেলে যাবো হাজার বছরের শ্লোক
সকল সাধারণ কথা যেন দৈব কথন।”
কবি আরো ভাবেন-
“ঈশান নৈঋতে মেঘ জমেনি বলে
নিশ্চিত হওয়ার কিছু নেই
প্রলয় কোনও দিন তোয়াক্কা করেনি বিপদসংকেত! “
যদিও কবি নৈঃশব্দ্যের পূজারী। নিজের সাথে নিজের কথোপকথন। কিন্তু ‘ক্ষরণের একতারা’ কাব্যগ্রন্থটির অধিকাংশ কবিতা বাস্তবের এক নির্মম চিত্ররূপ। মূর্ত হয়ে উঠেছে জীবনাচরণ ও দেশপ্রেম।
কখনো কখনো বিমূর্তভাবের অবতারণা হয়েছে বটে; ফুটে উঠেছে মনের নির্জনতা। অনুভূতিগুলো যেন প্রকাশ পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সুর মাত্রা লয়ে। এখানে কবির ‘এপিটাফ’ বাজে এইভবে,
“হে জোনাকি আলো
খুব অন্ধকারে রেখো না মায়ের কবর
এই আমি জোড় হাতে দাঁড়িয়ে আছি
মায়ের ঋণ মাথায় নিয়ে।”
কবির জীবন-জগৎচিন্তা পুরো কাব্যগ্রন্থজুড়ে যেভাবেই ফুটে উঠুক না কেন; সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে কবির দেশপ্রেম। প্রকাশ করেছেন জন্মভূমির প্রতি সকাতর অনুভূতি
“প্রিয় জন্মভূমি
তুমি তীর্থ
পুণ্যের পার্থিব জান্নাত
যাবো না দূরের দেশে
এই আছি বেশ, পলিময় জলকাদায়
পার্বণ উৎসবে।”
দেশমাতৃকার প্রতি কবির নিবেদন,…
“এই জনপদে দীপঙ্কর আলো
আরও দূর উয়ারী-বটেশ্বর
এই মৃত্তিকা
অহিংসার উত্তরাধিকার
প্রিয় জন্মভূমি
‘আমি তোমায় ভালোবাসি।’
“ক্ষরণের একতারা” কাব্যগ্রন্থটির সার্থকতা খুঁজতে গেলে দেশপ্রেম বিষয়টি নাড়া দেয় বেশি। তাছাড়া এই কাব্যগ্রন্থে ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে সাবলীল শব্দচয়নে কবি টিটো নতুনত্ব এনেছেন, এনেছেন বৈচিত্রতা বাক্যগঠনেও। কবিতার অবকাঠামোতেও এনেছেন অভিনবত্ব। অনেকের কাছে মনে হতে পারে; এ যেন ভিন্নমাত্রার এক ব্যতিক্রমী কবিতাগ্রন্থ! তবে আমি মনে করি, কবিতার কোনো নিজস্ব রূপ নেই। প্রকৃতির মতো কবিতা তার নিজস্ব গতিতে, নিজস্ব দ্যোতনায় গড়িয়ে যাবে। তাই কবি টিটো’র ভাষায়, কবিতার কোনো ইহকাল নেই- নেই পরকাল।
কবি বলেন,
“কবি অন্তহীন সময়ের ধ্বনি
কবি প্রেমিক যে কোনও যুগে
প্রকৃতির সুর থেকে শব্দ খুঁজে
লিখে রাখে সময়।”
কবিতার দিগন্তছোঁয়া ভাবনার স্রোতে “ক্ষরণের একতারা” কাব্যগ্রন্থ কালের যাত্রায় স্বাক্ষর রেখে যাবে- এই কল্পনা করতেই পারি। কবি টিটো’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পিতা ধর্ম মাতা বসুমতী’ ২০০৭এ এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ক্ষরণের একতারা’ ২০১৭এ প্রকাশিত হয়। কবির এই পদযাত্রা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক, এই কামনা করি প্রাণান্তকর।