‘ব্ল্যাক বিউটি’ উপন্যাসের সেই কালো ঘোড়া অথবা ‘কল অফ দা ওয়াইল্ড’ উপন্যাসের নেকড়ে বাঘ, ‘দি লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দি ওয়াড্রোব’ গল্পের সিংহ অথবা শরৎচন্দ্রে চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পের সেই গরুটির চরিত্র-সাহিত্যের পাঠকের কাছে খুব চেনা। তাদের আবেগের খুব কাছ-ঘেঁষা। বলা যায় এক ধরণের ভালোবাসায় জড়ানো।
দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তার কোন এক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রাণীকূলের প্রতি নির্দয় আচরণ করে সে অন্য মানুষের বেলাতেও একই ধরণের নিষ্ঠুর আচরণ করে।’ গল্প অথবা উপন্যাসে কোন একটি প্রাণীকে বোধ হয় লেখকরা মূল চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন মানুষের ভেতরের নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচিত করার জন্যই। শিশু সাহিত্য অথবা বড়দের লেখা, দুই ক্ষেত্রেই এরকম প্রাণীর চরিত্রকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে অসাধারণ সব কাহিনি এবং চরিত্রগুলো সাহিত্যের ইতিহাসে লাভ করেছে ভিন্ন মর্যাদা।
এই পৃথিবীতে মানুষ প্রকৃতির মধ্যেই বসবাস করে। কিন্তু তারপরেও মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করতে দ্বিধা করে না। মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য যেমন নষ্ট করে তেমনি অমানবিক আচরণ করে অন্য প্রাণীকূলের সঙ্গেও। এই পশুপাখিদের ওপর মানুষের অমানবিক আচরণের স্বরূপ বারবার উন্মোচীত হয়েছে এ ধরণের লেখার মাধ্যমে।
পশুপাখিকে সাহিত্যে ব্যবহারের বড় উদাহরণ ঈশপের গল্প। সেখানে এই প্রাণীদের সবসময় মানুষের চাইতে বেশী বুদ্ধিমান আর মানবিক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অ্যানা সিউওয়েল ১৮৭৭ সালে লিখেছিলেন তার উপন্যাস ‘ব্ল্যাক বিউটি’। একটি রেসের ঘোড়ার গল্প। কালো রঙের সেই ঘোড়ার প্রভুভক্তি আর মানবিক আচরণ উপন্যাসে মানুষের অমানবিকতাকেই ভীষণ ভাবে প্রকাশ করেছে। বিশ্ব সাহিত্যে এই উপন্যাসটি এখন প্রচুর বিক্রি হওয়া উপন্যাসের তালিকায় রয়ে গেছে এখনো। প্রাণীদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে রেসের ঘোড়ার ওপর অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই উপন্যাসটি জনমত গড়ে তুলেছিল।
উপন্যাসে পশুপাখিদের চরিত্র নিয়ে কাহিনি লেখার সময় লেখকরা প্রাণীদের আবেগ অনুভূতির দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো গল্পটা উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। এতে করে মানুষের অমানবিক আচরণের প্রতি তাদের ভাবনার জায়গাটা কল্পনার হাত ধরে বারবার প্রধান হয়ে উঠেছে। এই চরিত্রগুলো মনুষ্য চরিত্রের মতোই আচরণ করেছে। পাঠকরাও তাদের আর আলাদা করে ভাবতে পারে না। হারম্যান মেলভিলের উপন্যাস ‘মবি ডিক’, এক বিশাল আকৃতির তিমি মাছের প্রতিশোধ নেয়ার কাহিনি। উপন্যাসের আড়ালে লেখকতো মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে প্রকৃতিকেই একটি তিমি মাছের চরিত্রের আদলে দাঁড় করিয়েছেন। প্রকৃতিকে মানুষ ধংস করেছে অতীতে এবং এখনো করছে নির্বিচারে। প্রকৃতি রুষ্ট হলে তার পরিণতি কী হয় সেটা লেখক দেখিয়েছেন সেই তিমি শিকারী ক্যাপ্টেন এহ্যপের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে।
শুরুতে বলেছিলাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পের কথা। এক কিশোরী বালিকার পোষা প্রাণটির বেদনার যে অসাধারণ চিত্র শরৎচন্দ্র এঁকেছেন তা পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হয় মহেশ তো নিছক একটি গরু নয়, স্নেহ, ভালোবাসার আকাঙ্খায় সেও যেন আরেকটি মানুষ। তাকে আলাদা করা যায় না মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট থেকে।
বাংলা সহিত্যে রূপকথার ধারায় দেখা যায় বিরূপ প্রকৃতি অথবা রাক্ষসদের আক্রমণের মুখে রাজকুমাররা যখন বিপন্ন তখন পাখি বা কোন একটি প্রাণী তার উদ্ধারকর্তা হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বারবার এভাবে বাংলা সাহিত্যে অন্যান্য গল্পেও প্রাণীরা মানুষের রক্ষাকর্তা হয়ে এসেছে।
আজকাল ইংরেজী সাহিত্যেও বেশকিছু চরিত্র তৈরী হয়েছে একেবারেই শিশুদের জন্য। এই চরিত্রগুলো চলে আসছে চলচ্চিত্রের রূপ নিয়ে পর্দায়। সেখানেও দেখা যাচ্ছে পিপড়া, ভাল্লুক অথবা ছোট জেব্রাকে দেখা যায় মানুষের মতোই সব বিরূপতা আর অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সাহিত্যে এ ধরণের চরিত্রের নির্মাণ আসলে আমাদের সভ্যতাকেই নিজস্ব দর্পণের মুখোমুখি করেছে। ইংরেজ কবি কোলরিজ তাঁর ‘রাইম অফ দি এনশিয়েন্ট ম্যারিনার’ কবিতায় অ্যালবাটরস পাখির হত্যাকান্ডের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার এক আশ্চর্য ছবি তৈরী করেছেন এই দীর্ঘ কবিতায়। বিনা কারণে পাখিটিকে মেরে ফেলার পর সেই জাহাজটিও গভীর দূর্যোগে পতিত হয়। এই অ্যালবাটরস পাখিও বিশ্বসাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছে।
অনিকেত রহমান
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট
ছবিঃ গুগল