0

লীনা ফেরদৌস
ঐশ্বরিক
ধুসর ঘাগরা আর আবির রঙা ওড়নায় সন্ধ্যা এসে নামে পাহাড়ের বুকে,পাহাড়ের সবুজ শরীর আরও জীবন্ত আর মোহময়ী
হয়ে উঠে বিশেষ এই মুহূর্তে।কেমন যেন মিষ্টি একটা বুনোফুলেরগন্ধ আর বেশ হাল্কা একটা ঠাণ্ডা হাওয়া সাথে নিয়ে
আসে সন্ধ্যা, এক ধরনের নেশা জাঁকিয়ে ধরে পাহাড়কে এইসময়টাতে। চারপাশটা ভীষণ রকম রঙিন হয়ে যায়- প্রতিটি
মেঘ,গাছ-লতা-পাতা যেন নিজেকে রাঙিয়ে নেয় সন্ধ্যার আবীরে।সারাদিন এই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়থাকলেও ঠিক
এই সময়টাতে কেমন একটা আড়ষ্টতা অনুভব করে পাহাড় ভেতরে ভেতরে। একরাশ লজ্জালু মায়া জড়ানো চোখে
অপলক তাকিয়ে থাকে পাহাড়সন্ধ্যার দিকে, সন্ধ্যার রাত পোশাকের মায়াবী রঙ তাকে আরও নেশাতুর করে তোলে।
এদিকে সারাদিন পাহাড়ের বুকের উপর আছড়ে পড়ে চঞ্চলা- চপলা ঝর্ণা, পাহাড়ের সাথে একটু সখ্যের জন্য নেচে গেয়ে
দিনভর মুখর রাখে,শীতল কলতানে নূপুর-নিক্বণের উচ্ছ্বাস, পাহাড়ের সবুজ অরণ্যে প্রাণের ছোঁয়া দেবার প্রবল তাড়না
তার, হৃদয় নিংড়ানো সিক্ত ভালবাসাকে বিস্ময়কর গুড়ি গুড়ি জলকণার মত ছড়িয়ে রাখে আকাশের পানে,ভালবাসার
রংমহলে পাহাড়কে সাজায় রোজ। কঠিন পাহাড়ের মন ছোঁয়ারকি চেষ্টা তার! অপরূপ সৌন্দর্যে প্রতি বরষায় নবরূপার মত
পাহাড়কে ভালবাসায় ভাসাতে এসে শুধু কষ্টই পেয়ে যায়, এক বুক কান্না নিয়ে সারাদিন তাই গান গেয়ে চলে গিরিনির্ঝর
আদুরী ঝর্ণা, কখনো পাহাড়ের আপন হতেই পারলো না, তাই তো যখন পাহাড় আর সন্ধ্যার নিবিড় আলিঙ্গনে রাত নামে,
অভিমানী ঝর্ণার কান্না অনেক দুর দূরান্তে ভেসে বেড়ায়, সেই কান্নাকে অনেকে ভাবে ঝর্ণার গান।
সন্ধ্যা যতই কাছে আসতে থাকে ততই পাহাড় চুপ হতে থাকে,কথা হারিয়ে যায় কোথায় যেন, গলা শুকিয়ে আসে, বড্ড
জল তেষ্টা পায় অথচ একটু আগেও এক পশলা বৃষ্টির জল আকণ্ঠ পান করেছে সে। চারপাশে ঘর ফেরতা পাখিদের কিচির
মিচির আর ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক,লাল-কমলা-নীল-বেগুনী আর ছাই রঙা মেঘদের নাচে আর তাদের হিমশীতল স্পর্শ
আরও বেশী শিহরিত করে পাহাড়কে, আরও রহস্যাবৃত করে তোলে চারপাশ, কি অদ্ভুত! কি অপার্থিব সে সৌন্দর্য সেট ঠিক
কোন শব্দ কিম্বা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না পাহাড়।
কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে এলোকেশী ইন্দ্রবতী কিশোরীর মত লালচে আভা গালে মেখে আলতো শরীরে সন্ধ্যা নিজেকে
এলিয়ে দেয় পাহাড়ের বুকে। সন্ধ্যার গায়ের মাদকী ফুলের ঘ্রাণের বড় আদুরে সে আলিঙ্গন কঠিন পাহাড়কে প্রগলভ
ভালবাসায় আরও স্তব্ধ করে দেয় আর ঠিক তখনি চুপ করে রাত নেমে আসে, স্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে যেন শুধু পাহাড়ের
স্পন্দন শোনা যায়, যেন এক প্রেমিকের গভীরতায় স্পর্শ করে কোন ঐশ্বরিক প্রেম, চাঁদ-জ্যোৎস্নায় ঝিরিঝিরি বাতাসে বুনো
ফুলের গন্ধ নিয়ে ছটফটে রাত কাটে তাদের- কত যে গল্প, কত যে খুনসুটি রাতের ইন্দ্রজাল জুড়ে যেন আদিম গুহাচিত্র
এঁকে যায়, ঐশ্বরিক সে চিত্র !
সারাদিনের ক্লান্তিকর সেই ঝর্নার গান পাহাড়ের কাছে ঠিক সেই মুহূর্তে আচানক অপার সুর মূর্ছনার মত শোনায় কিন্তু শুধু
ঝর্ণাই জানে এটা তার ভালবাসার আর্তনাদ – বড় স্বর্গীয় সেই সুর,সেই সময়- বড়ইঐশ্বরিক!