
বিমোচন ভট্টাচার্য
কাল বিকেলে হাতিবাগান যাবার ছিল। ড্রাইভার পাওয়া গেল না। তাহলে যাবো কি ভাবে? বাসে উঠলেও শ্যামবাজার থেকে হাঁটতে হবে। বললাম – চলো, রিকশা করে ট্রাম ডিপো গিয়ে ট্রামে করে হাতিবাগান যাই। তাই করলাম।
কত, কতদিন পর ট্রামে চড়লাম! রাস্তায় আধুনিক ট্রাম দেখেছি। সেকেন্ড ক্লাস নেই। ওপরটা ফাইবার গ্লাসের। এসি ট্রামও বেরিয়েছে নাকি শুনেছি। কিন্তু আমরা দুজন যে ট্রামটায় চড়লাম সেটা সেই পুরনো ট্রাম। প্রত্যেক ট্রামের একটা নিজস্ব নম্বর থাকে, জানেন। না রুট নম্বর নয়। ট্রামের নিজস্ব নম্বর।আমাদেরটার নম্বর দেখলাম ৬৯৭।
এই ট্রামটা একেবারে আমার স্মৃতির ট্রামের কার্বন কপি। সেই তিনটে পাখা। বয়স্ক, ভদ্র কন্ডাকটর। সাদা পাতলা টিকিট। আমার বড়দার একটা মান্থলী টিকিট ছিল। দাদা শিখিয়েছিলেন – দেখবি, ড্রাইভারের দরজার মাথার ওপর লেখা থাকে Last date of renewal, আর তার নীচে Last Date of deposit refund। দেখলাম এখনো লেখা আছে।
দাদার কথা মনে পড়লো। উঠেছিলান ডিপোর ভেতর থেকে। তিনচারজন ছিলেন তখন। ট্রামটা বাইরে আসতেই প্রায় ভরে গেল।
এক যুবতী মা উঠলেন তার বছর সাত – আটের ছেলেটিকে সংগে করে ছেলেটি উঠেই ছুটে চলে গেল সামনের সীটে। বিরাট ফাঁকটা দিয়ে ড্রাইভারের পুরো কার্যকলাপ স্পষ্ট দেখা যায়। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম দু হাজার ষোল সালের সাত আট বছরের বাচ্চার সংগে উনিশশো সাতান্ন র সাত আট বছরের বাচ্চার কোন তফাৎ নেই। সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে।। ড্রাইভারের দরজাটা খুলে খুলে যাচ্ছিল সেই আগের মতই। তখন একটা পুরনো শ্যাওলা পড়া ইঁট দিয়ে বন্ধ থাকতো দরজাটা। উঁকি মেরে দেখি আজও সেই শ্যাওলা পড়া ইঁট দিয়েই বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছে দরজা টাকে।সেই ইঁটটাই নয় তো!! হেসে ফেললাম মনে মনে।
নামলান মিত্রা সিনেমার সামনে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে গড়গড় আওয়াজ করতে করতে ১ নম্বর ট্রাম চলে গেল এসপ্লানেডের দিকে।
মেয়েটা আসবে অফিস থেকে উবের ট্যাক্সিতে। বেশ কিছুক্ষন সময় ছিল হাতে। শম্পা বললো চা খাবে। মোহনবাগান লেনে নর্দমার ধারে একটা চায়ের দোকানে ভাঁড়ে চা খেলাম দুজনে।
হাতিবাগানের সেই জৌলুশ নেই আর। টিমটিম করে তিনটে সিনেমা হল টিকে আছে। থিয়েটার হল, নবরুপে নির্মিত স্টার ছাড়া আর একটাও নেই। এই হাতিবাগান আমার চেনা হাতিবাগান নয়।
তবু হাতিবাগান মানেই একগুচ্ছ নস্টালজিয়া।
হাতিবাগান মানেই বাবা মার সাথে নাইট শো সিনেমা দেখা। হাতিবাগান মানেই মাঠ থেকে খেলে ফেরার পরে রাধা সিনেমার পরে দাসগুপ্তর খেলার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ব্লাকবোর্ডে লেখা মোহনবাগান, ইস্টবেংলের লীগের প্রত্যেকটি খেলার রেজাল্ট দেখার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা।হাতিবাগান মানেই স্টারের উল্টোদিকের জুতোর দোকান থেকে চটি কেনা। ওখান থেকেই চটি কিনে পরতাম আমরা।রামলাল সুইটস বলে একটা মিষ্টির দোকান ছিল সকাল বেলা কলাপাতায় মুড়ে মাখন বিক্রী করতো তারা। তখনো আমুল মাখন আসেনি। ওই মাখন লাগিয়েই পাঁউরুটি খেতাম আমরা। হাতিবাগান মানেই, সেই কবে থেকে, আমার ছেলে বেলা।
অনেক অনেক বদলে গেছে হাতিবাগানের বাইরেটা। কিন্তু নামটাই অনেক আমাদের কাছে। কোথায় যেন আজও এক টুকরো উত্তর কলকাতা আটকে রয়েছে গলিগুলোর মধ্যে।যা এক লহমায় পৌঁছে দেয় আমাদের ছোটবেলায়।
বারবার…. লাগাতার…..।
ছবি: লেখক ও গুগল