
কাশফিয়া ফিরোজ
শুনতেকিপাই?
গত কয়েকদিন ধরে মিডিয়া তোলপাড় হচ্ছে বনানী ধর্ষণ মামলাকে কেন্দ্র করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলে জ্বালাময়ী সব প্রচারণায় অংশ নিয়েছি কমবেশী আমরা সকলেই। জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতা কিংবা টেলিভিশনের প্রধান শিরোনাম কোনটাই তো বাদ যাচ্ছেনা।হ্যাঁ, আমরা অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।আমরা ধর্ষণের মতো বর্বরচিত যৌনসহিংসতা থেকে পরিত্রাণ চাই।ঢাকা মেডিকেলের বিছানায় শুয়ে ৫বছরের যে শিশুটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আমরা তার দৌড়ে বেড়ানো বিকেল গুলো ফিরে পেতে চাই।গ্লানি আর অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে যে মেয়েটি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে আমরা তার জন্য ন্যায় বিচার উপহার দিতে চাই।
তবে? কোথায় সেই বাধা? কোথায় সেই ন্যায়-বিচার?
আইন আছে, বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতাও আছে।আর আছে খুঁটির জোর।
মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি, খুঁটির জোর কি তবে রাস্ট্রযন্ত্রের চাইতেও শক্তিশালী? তবে কি সকল অপরাধীই প্রভাব শালী?
নাকি অপরাধ এবং অপরাধী সর্বদাই রাজনৈতিক ভাবে আর্শীবাদপুষ্ট?
কি শহর কি গ্রাম, সকল ক্ষেত্রেই দুঃস্কৃতিকারী ক্ষমতাবান।সব ধর্ষণের ঘটনার যেন বাধাধরা ফরমেট।ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে, লোক-লজ্জার ভয়ে নির্যাতিতার পরিবার মুখ লুকিয়ে থাকবে, অপরাধীর স্বজনরা ভয়ভীতি প্রর্দশন করবে।অতঃপর মামলা (হতেও পারেনাও পারে) ।মামলা হলে ক্ষমতার চাপে তা অচিরেই প্রত্যাহার কিংবা জামিনে মুক্তি পেয়ে ধর্ষকের বীরদর্পে প্রত্যাবর্তন।আর কোন কোন ক্ষেত্রে এই মানসিক চাপ নিতে না পেরে সারভাইভার না ফেরার দেশে চলে যাওয়াকে শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত হিসেবে বেছে নেয়।আচ্ছা, ক্ষমতার খুব কাছে থাকলেই কি অপব্যবহার করতে মন চায়?
বুঝিনা, যারা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য কর্মের অপরাধী তাদের কেন কোন চক্ষুলজ্জা নাই? বিনা সম্মতিতে জোর পূর্বক যে সম্পর্ক তাতে আর যাই থাকুক আনন্দ কিংবা ক্ষমতা নেই। জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ককে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ পরায়ণতা, ক্ষমতার শো-ডাউন, পুরুষতন্ত্র কিংবা মানসিক বিকৃতি যেই ছকেই ফেলিনা কেন, সবক্ষেত্রে হার কিন্তু সেই পুরুষ লিঙ্গেরই।যাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পুরুষ নিজেকে ফিরে পেতে চায়, নিজের অক্ষমতাকে আড়াল করতে চায়, নিজেকে পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আত্ম-অহমিকায় ভেসে যায় – সে নিজে খুব ভালো করেই জানে নিজের দূর্বলতা, সীমাবদ্ধতা, অক্ষমতা।
একজন হেরে যাওয়া পুরুষই পারে ৫বছরের শিশুকে ধর্ষণ করতে!
তবুও হাল ছাড়িনি
তবুও হাল ছাড়েনি।
এতো কিছুর পরও আমরা হাল ছাড়িনি।আমরা প্রতিবাদে মুখর।
আমরা বিচার চাই, ন্যায়-বিচার।আমরা চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, আইনের কঠোর প্রয়োগ।
মুখগুজে সহ্য করার দিন গত হয়েছে বেশ আগেই। হ্যাঁ, মেয়েরা এখন প্রথাভেঙ্গে বের হয়ে এসে প্রতিবাদে মুখর। ধামাচাপা দেবার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সহিংসতার ভয়াবহতার কথা প্রকাশ করছে অকপটে। বর্তমানের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, কেন একমাস পর কেস রের্কড হয়েছে বনানীর ধর্ষণ মামলায়? অথচ, ভয়কে জয়করে কতিপয় ক্ষমতাশালী গোষ্টীকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সাধুবাদ পাবার যোগ্যতা রাখে সেইদু’জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী।পুরানো ঢাকার মেয়েটিও গত সপ্তাহে প্রথমে নিজ এলাকার গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গের কাছে এবং পরে থানায় কেস ফাইল করেছে, সাতক্ষীরার ৮বছরের শিশুটিও জবানবন্দীতে অকপটে বলে গিয়েছে বর্বরতার আদ্যপান্ত।
আইনও শালিস কেন্দ্রের সূত্রমতে, জানুয়ারী থেকে মার্চ ২০১৭ অবধি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৩টি, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২১জনকে, ধর্ষণ পরবর্তী মৃত্যু হয়েছে ৫টি, আর ধর্ষণ পরবর্তী আত্মহত্যা ১টি।বলাবাহুল্য যে, অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি আজ অবধি, তথাপি আশাবাদী এই ভেবে যে, মেনে নেবার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বিচারের জন্য আবেদন করছে আজ অনেক পরিবার। কোন কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে দেখেছি গ্রামবাসীকেও।অপরাধীকে চিহ্নিতকরণ, ধরিয়ে দেয়া এবং এলাকায় নিরাপত্তা বুহ্য গড়ে তোলার মতো দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়েছে ইতোমধ্যে।গণমাধ্যমগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে দ্রুততম সময়ে সংবাদ প্রচারও প্রসারের। সরকারী ও বেসরকারী সাহায্য সংস্থাগুলো বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।তবে?
নিজেকেই প্রশ্ন করি, আমরা কি তবে ভুল পথে হাটছি?
কোথায় পাবো তারে ?
ভাবি, ভেবে ভেবে দিশেহারা হই।কোথায় পাবো তারে?
যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা – একের পর এক।তারপরও থেমে নেই আমাদের সংগ্রাম।
স্কুলপর্যায়ে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে ’যৌন ও প্রজনন শিক্ষা’।কিন্তু নেই তার যথাযথ প্রয়োগ। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বিশেষ এই অধ্যায়কে তামাশার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।এই অধ্যায় নিয়ে আলোচনা কিংবা প্রশ্নপত্রে অর্ন্তভুক্ত করাতো দুরের কথা বরং অতিশয় রক্ষণশীলতার নামে বাসায় নিজে নিজে পড়ে বুঝে পরামর্শ দেয়া হয়।সনাতন শিক্ষাব্যবস্থা আর মূলধারার সংস্কৃতি তাই ’যৌনতা বিষয়ক’ সেই আদি ও অকৃত্রিম ধারাকেই বহন করে চলেছে যুগের পর যুগ ধরে।তাই তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণের যুগেও পুরুষরা ভেবেই নেয় ’নারী’ সেতো শুধু বিনোদন আর উপভোগের এক সুব্যবস্থা মাত্র।নারী যতই তাকে প্রত্যাখ্যান করবে পুরুষ তাকেই ’ভদ্র ’মেয়ে উপাধি দিয়ে ’সম্মতির’ ইঙ্গিত বলে ধরে নিবে।কিশোর বয়স থেকে এই শিক্ষায় ছেলেরা দীক্ষিত হয় যে, মেয়েরা কখনোই যৌন চাহিদায় সাড়া দিবেনা।তাই যা করার তাকেই করতে হবে।নতুবা আসল পুরুষের বদলে ’হাফলেডিস’ তকমা লাগিয়ে মরতে হবে ধুকে ধুকে।তাছাড়া, পুরুষ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র যৌনচাহিদা নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে সে-যে একেবারেই অক্ষমতা ফলাও করতে অদৃশ্য অহমিকার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়।
শহর কিংবা গ্রাম, নেই বিনোদনের সুব্যবস্থা।গান, নাটক কিংবা সিনেমা সর্বত্র সেই একই মেসেজ।ছেলেটি স্কুলের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, প্রেম নিবেদন করবে, মেয়েটি প্রত্যাখ্যান করবে আর সেই প্রত্যাখ্যানেই ছেলেটি খুজে পাবে সম্মতির সূত্র।সবমিলে গেলে ফুলেফুলে টোকা-টুকি আর একবারেই নিমরাজি হলে দলেবলে বন-জঙ্গল-মাঠ (দেহ পাবি মন পাবিনা)।বাড়ির ছোট শিশুটিও এই দেখেই বড় হচ্ছে যে, সংসারে সুখের জন্য বাবা মাকে যদি নির্যাতনও করে তবে তার পুরোটাই তাদের সামগ্রিক মঙ্গলেরই জন্যে।
বেশ কিছুদিন আগের কথা। শিশুধর্ষণের ঘটনায় তৎক্ষণাৎ এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহের সময় জানতে পারি, ধর্ষণ চলাকালীন সময়ে শিশুটিকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলো এলাকার কিছু কুকুর।কুকুরের তাড়াখেয়ে পালাতে বাধ্য হয় আসামী। পশু যদি বুঝতে পারে বিনা সম্মতিতে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক অন্যায় তবে ওরা কেন বোঝেনা ?
ছবি: গুগল