
শেখ রানা (এডিনবরা,স্কটল্যান্ড থেকে)
এক
স্টারবাকস কফি শপ।
নিকলসন স্ট্রিট এর একদম প্রাণকেন্দ্র। এডিনবরার জীবনের শেষ সপ্তাহে এসে মনে পড়লো এখানে বসে বিস্তর লিখেছি এই চার বছর। আমার জন্য আনন্দ সময় ছিলো সেসব।
আজ ক্যাফেতে ঢুকতেই কাউন্টার এর ও প্রান্ত থেকে সাদর অভ্যার্থনা পেলাম। একটু চমকেই গেলাম। অনেক দিন পর এলাম বলে? নাকি বিদায়ের সানাই অলক্ষ্যে বেজে উঠছে অদৃশ্য টংকারে?
‘অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম।’
‘হ্যা, কেমন আছো?’
‘ভালো। ফেস্টিভেল মাস। ব্যস্ত সময় আমাদের।’
আগস্ট এলেই এডিনবরা সিটি সেন্টার রঙের পসরা মেলে ধরে। সারা পৃথিবীর পর্যটক ভিড় জমায়।
‘তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ। এই ক্যাফেতে চমৎকার সময় কাটিয়েছি আমি। আমার একটা বই এর আছে। ট্রাভেলগ বিষয়ক। বেশিরভাগ লেখাই এখানে বসে লিখেছি।’
‘কি বলো! তুমি লেখক? ওয়াও! তুমি কি বিখ্যাত লেখক?’
কথার ধরণে হেসে ফেলি আমি।
‘নাহ, আমি বিখ্যাত লেখক না। আমি গীতিকার, লেখক। আনন্দ নিয়ে লেখালেখি করি।’
কথা বলতে বলতে আমার কাপুচিনো চলে আসে। দাম পরিশোধ করে টেবিল এ যাব, ফিরে আসি আবার।
‘আমরা লন্ডনে যাচ্ছি, দুই বছরের জন্য। এই ক্যাফেতে বসে লেখালেখি মিস করবো।’
‘আমি তোমাকে অনেক মিস করবো। যাবার আগে একবার এসে বিদায় জানিও। আমার ভালো লাগবে।’
মাথা নেড়ে আমি কাপুচিনো নিয়ে বসে যাই। ও পাশ থেকে ব্যস্ত পর্যটকদের দেখা যায়। রোদ ঝলমল দিন আজ। আমি যদিও খানিক বিষন্নতায় বসবাস করছি এখন। সেই রাজসিক বিষন্নতা ফিরে আসছে- টের পাই।
আমি ব্যাগ থেকে গীতিকবিতার পাণ্ডুলিপি বের করি। এ মাসেই প্রকাশক-কে পাঠাতে হবে।
আগ্রাসী রোদে আমার চোখে পড়ে একটা বৃষ্টির লিরিকে।
দুই.
একটু এগিয়ে গেলেই শামীম ভাই এর পোস্ট অফিস।
অসাধারণ একজন মানুষ। বর্ণীল এক জীবন আর নানা গল্প আছে শামীম ভাই এর। দেখে বোঝার উপায় নেই অতীতের চড়াই-উৎরাই। মাঝে মাঝেই ফোন করে চলে আসি পোস্ট অফিসে। শামীম ভাইও আমাকে পেলে স্মৃতিকাতর হন। নানা দশকের গল্প শুরু হয় আমাদের। রাজনীতি থেকে গল্প এসে ঠেকে নাটকে।
এডিনবরায় এইসব স্বজনদের সঙ্গে সময়টা আমাদের ভালো গিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ্। এই শহরের শান্ত, সহজিয়া তরঙ্গটা বেশির ভাগ মানুষ ধারণ করেছেন। ভালো লাগে। এডিনবরা আর এই স্বজনদের ছেড়ে যেতে নিশ্চিতই খারাপ লাগবে।
আজ দীর্ঘ আড্ডায় আমরা দুজন বসে বসে একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন
এর রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের গান-কবিতা সহ নানাবিধ সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে পরিকল্পনা হয়।
কথা হয়,অক্টোবরে আমাদের প্রথম অনুষ্ঠান হবে। ভালো হলো, এডিনবরায় ফিরে আসার একটা উপলক্ষ পাওয়া গেল।
তিন.
পান্ডুলিপির কাজ একটু এগিয়ে নিয়ে আমি আনিস আহমেদ এর ঢাকাইয়া আসলি বইটা খুলে বসি। দ্বিতীয়বার পড়ছি বুকমার্ক করে রাখা জায়গাগুলো। সেখান থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে টুকরো নাগরিক জার্নাল শেষ করি আজ-
‘ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই বহিরাগত মুঘলদের কাছে তৎকালীন বাংলা ভাষী ঢাকাইয়ারা নিচু জাত-পাতের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়ে কুট্টি(ছোট লোক) পরিচিতি লাভ করে এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি কুট্টিদের নামে নামকরণ করা হয়। বহিরাগত পশ্চিম ভারতীয় ও পশ্চিমা অভারতীয়রা (ইরান-আফগান) নিজেদের সোববাস বা অভিজাত শ্রেণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সোববাসদের কাছে ঢাকার পরিচিতিটা এমনভাবে পাওয়া যায় তখনকার একটা প্রচলিত ছড়ায়-
ঢাকা আজিব শাহার
নাম জাহাঙ্গীর নাগার,
দো চার শারিফ হ্যায়
বাকি কুট্টি তামাম।’
ছবি: গুগল