
শারমিন জান্নাত ভুট্টো
অনেকটা আঙ্গুল দেখিয়ে পাশ হলো বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন। প্রধানমন্ত্রী দেখিয়েছেন তার বৃদ্ধাঙ্গলী মানবাধিকার ও এনজিওকর্মীদের প্রতি। ধর্ষকরা দেখাচ্ছেন প্রতিনিয়ত তাদের মধ্যমা আর অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুরা যারা বলির পাঁঠা হচ্ছে তাদের এগিয়ে দিতে হচ্ছে অনামিকা।যেসব পুরুষের একটু বেশী আগ্রহ ও নজর মেয়ে শিশুদের প্রতি তাদের জন্য তো বিশেষ বিধানে বাল্য বিবাহ আইন একেবারে সোনায় সোহাগা। ধর্ষকের অত্যাচারের শিকার হয়ে যখন কোন মেয়ে অনাকাঙ্খিত কোন ভবিষ্যৎকে পৃথিবীতে আনতে বাধ্য হয় তখন সেই শিশুর জন্য সবার দরদ উতলে পড়ছে দেখে হাসি পায়। তবে সে হাসি নিছকই এক বেদনার হাসি। বর্তমানের শিশুদের রক্ষা করতে না পারলেও অদূর ভবিষ্যৎ এর দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়।
গত কয়েক বছরের কিছু ঘটনা উল্লেখ করছি আজকের এ লেখায় শুধুমাত্র বোঝাবার জন্য কিভাবে হায়েনার দল ভবিষ্যতে এ বিশেষ বিধানে বিয়ে আইনটিকে কলুষিত করবে।
ঘটনা এক: ২০১৬, ২১শে সেপ্টেম্বর
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীকে বিয়ে দেয়া হয় ধর্ষক রাকিব শেখের সঙ্গে। এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। ধর্ষক রাকিব শেখ যখন রাস্তায় একা পেয়ে নির্জন বাড়িতে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে কয়েক দফা ধর্ষণ করে আর পরবর্তীতে ধর্ষিতার বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে আসে তখন বোঝাই যায়, ধর্ষকের মনে আর যত কিছুই থাকুক না কেন অন্তত মায়া-মমতা আর ভালোবাসা ছিল না। আর সেই নরপশুটার বিচার না করে উপরুন্ত তাকে বাঁচাতে যদিও এলাকাবাসীর দৃষ্টিভঙ্গীতে(অনেকটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো ছিলো) মেয়েটির ভবিষ্যৎ ঠিক রাখতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ঘটনা দুই: ২০১৪, ১৯শে এপ্রিল
বড়লেখায় আড়াই লাখ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছে এক কিশোরী ধর্ষিতার।সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া সেই ধর্ষিতার বাবা লিখিতভাবে থানায় অভিযোগ করলেও পরে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি,জনপ্রতিনিধি,প্রশাসন আর রেজিষ্টি অফিসের যোগসাজশে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয় আর ধর্ষক সকল প্রকার অপবাদ থেকে নিজেকে মুক্ত করে বনেবাদারে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বামীর পদবী গলায় ঝুলিয়ে।আইন, শাস্তি আর বিচার আপাতত এ শব্দগুলোর নিকুচি করা হয়েছে এ ঘটনায়।
ঘটনা তিন: ২০১২, ১১ই জুন
গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে ধর্ষণের শিকার হয় ৪র্থ শ্রেণী পড়ুয়া এক ছাত্রী (৯বছর)। ধর্ষক জিল্লুর রহমান (২৪) ধর্ষণের দায় এড়াতে সেই সময় স্কুল ছাত্রীকে বিয়ে করে। তবে দুই মাসের মাথায় তালাক দিয়ে সেই শিশুটিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। গ্রাম্য টাউট-মাতবররা সেই সময় জিল্লুরকে বাঁচাতে এ বিয়ের নাটকের আশ্রয় নেয় এবং ধর্ষিতার পরিবার যাতে কোন ধরনের আইনী ব্যবস্থা নিতে না পারে তাই বিয়ের কাজ সম্পন্ন করার কয়েক মাসের মধ্যেই আবার তালাকের ব্যবস্থা হয়ে যায়। ধর্ষিতার পরিবার বোধকরি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্বারে দ্বারে বিচারের আশায়।
উপরিল্লিখত মাত্র তিনটি ঘটনা তুলে ধরা হল শুধুমাত্র ধর্ষণ ও বাল্যবিয়েতে মশগুল দেশের পরিস্থিতি বা অবস্থা অবলোকনের জন্য। বেশী না শুধুমাত্র তিনটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। কারো জানা থাকলে উত্তরটা জানিয়ে দেবেন অনুগ্রহ করে।
১. বর্তমান অপেক্ষা কি ভবিষ্যৎ বেশী গুরুত্বপূর্ণ? কোন শিশুর যদি বর্তমান নিশ্চিত করতে না পারি তবে ভবিষ্যৎ এ কিসের আশায় তা ভালো থাকবে?
২. প্রতিবছর এতো এতো মেয়ে স্কুলে পড়াশোনা করছে জিএসসি,এসএসসিতে ভালো ফল করবার আশায়। সরকার থেকেও স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে যাকে অবশ্যই আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়ে শুধুমাত্র আইনের বেড়াজালে পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে সে কি আর কখনো পারবে স্কুলের ত্রিসীমানায় পা রাখতে?
৩.ধর্ষিতা, তালাকপ্রাপ্ত কিংবা বিধবা কাউকেই কি সমাজ,রাষ্ট্র কিংবা দেশ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে?
বাল্যবিবাহ কমানোর প্রয়াসে যে আইন প্রণয়ন করেছে সরকার,তাতে কতটুকু কমবে জানা নেই তবে শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়ার যে নতুন সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে আইনের আঙ্গুলের ফাঁকেই তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লামা শফি নামক এক ব্যক্তি মেয়েদের শুধুমাত্র ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াতে বলছেন যাতে করে বিয়ের পরে তারা স্বামীর টাকা গুনতে পারে। যে হারে বাল্যবিয়ে বাড়ছে তাতে করে হয়তো সরকার অচিরেই আল্লামা শফির স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎবাণী সফল করতে পারবে। সবই হলো ইশারা আর আঙ্গুলের খেলা…
ছবি: অনিরুদ্ধ দাস