
রহমান রাফিজা
(বেলজিয়াম থেকে): মাদার তেরেসার ভাষায় ‘গতকাল চলে গেছে। আগামীকাল এখনও আসেনি। আমাদের কাছে
আছে আজকের দিনটি। চলুন। শুরু করি’ ।কি,
কিভাবে , কোথা থেকে শুরু হবে – তা এখনই
ভাবার সময়। আর মুহূর্ত অপেক্ষা নয়।
দেশ একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছে ।
চারদিকে ঘটনা , দূর্ঘটনা, সমস্যার সারি।বিপদ
যেন পিছু ছাড়ছে না।একদিকে মহামারী করোনার উপদ্রব ।অন্যদিকে ঘূর্নিঝড় আম্পানের আঘাত।
তার ওপর মানবসৃষ্ট অগ্নিকান্ড।প্রত্যেকটি ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বেড়ে চলেছে।

ইউনাইটেডের অগ্নিকাণ্ডে যারা মারা গেলেন
সম্প্রতি একটি সুপরিচিত হাসপাতালে এসি থেকে অগ্নিকান্ড ঘটেছে এতে ৫ জন করোনা রোগী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়।ঘটনায় বিস্মিত হয়েছি। প্রশ্ন আসে অত্যাধুনিক একটি হাসপাতালে কিভাবে এটা হতে পারে। তাহলে কি ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ছিলো? কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা? আর্থিক সংকট? পেশাদারিত্বের অভাব নাকি নিছক অবহেলা ছিলো?
একটি ছোট বিষয় দিয়ে শুরু করি ।গত বছর প্যারিস থেকে এক পারিবারিক বন্ধু দেশে ফিরলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।মাইল্ড ষ্ট্রোক করে। তাকে চিকিৎসার জন্য অগ্নিকান্ড সংঘটিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুলশানে অবস্থিত এ হাসপাতাল ধনবান ব্যক্তিদের কাছে পরিচিত এবং নির্ভরের জায়গা। নাম যশ অর্থ সম্পদ সবই অর্জন করেছে।
কারো কারো মুখে শুনেছি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা এত ভালো যে একেবারে বিদেশের মতো।বিদেশের মতোই বটে! বাইরের ডাক্তার!! ঔষধপত্র যা দেয় কোনটাই দেশী না !!! যন্ত্রপাতি গুলো খুবই আধুনিক। ডাক্তার , নার্স খুব আন্তরিক। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম পরিবেশ ।তবে চিকিৎসার মান কেমন ? তা জানা যায় কম । সবার দেখানোর সুযোগ রয়েছে কিনা? আমজনতার চিকিৎসা পাবার সুযোগ কতখানি ? তা জানা যায় না !
রোগীটিকে দেখতে যেয়ে হাসপাতালের ভেতর, বাহির এবং সার্ভিস দেখা হলো ।ভদ্রমহিলা যে কক্ষে ছিলেন সেটি বেশ বড়সড়। আর্ন্তজাতিক মানের হোটেলের একটি স্যুটের মতো। কক্ষটিকে একটি আধা দেয়াল দিয়ে ভাগ করা হয়েছে।একপাশে দামী সোফা পাতা।ছোট একটি বাড়তি বেড রয়েছে। অনেকটা ড্রইংরুমের মতো।তার সঙ্গে লাগানো রোগীর বেড ও যাবতীয় জিনিস। খাবার টেবিল চেয়ার . . . . ইত্যাদি ।আলীশান ব্যাপার স্যাপার ।বেল চেপে যে কোন মেনুর অর্ডার করা যায়।রোগীটি মাস খানেক থেকেছেন ।ভেকেশান কাটানোর মতো বিষয় আর কি !!
রোগীর হাসিমুখ খানা প্রমান করছিলো তিনি তৃপ্ত এবং সমাজে একটি উচু জায়গা দখল করে আছেন।কক্ষে যারা ছিলেন সবাই ইংরেজীতে না হয় ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন। পরিবারটি মাল্টি কালচারাল বোঝার বাকী রইল না।বোঝা গেল এখানকার আকাশ ছোয়া খরচ বহন করার সামর্থ্য তার রয়েছে।
বিভিন্ন জন থেকে শুনেছি এখানকার রোগীরা শুধু চিকিৎসার জন্য আসেন না। ধনবান এবং উচ্চ পদস্হ ব্যস্ত ব্যক্তিরা জ্বর , সর্দি,কাশি হলে কিম্বা ক্লান্তি কাটাতে এখানে চলে আসেন। কিছুদিন বিশ্রাম করে চলে যান ।তাদের জন্য অর্থ কোন বিষয় না ।এনার্জি বাড়ানো নাকি মূল উপলক্ষ্য।
ছোট আরও একটি বিষয় নজরে পড়ে। হাসপাতালে ঢোকার পর লিফ্ট দিয়ে উপরে উঠতে যাব গেইট ম্যান বললেন অ্যাপ্রোন পরে ঢুকতে হবে । ভাবলাম ভালোতো বেশ হাইজেনিক ।কোথায় পাব জানতে চাইলে বলেছিলেন নীচ থেকে কিনে আনতে হবে ! একটু ধাক্কা খেলেও ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে রোগীকে দেখে এসেছিলাম ।আরও মজার ব্যপার হলো ফেরার পথে এটি জমা দিয়ে আসতে হয়েছে। এটাই নাকি নিয়ম!
রোগী দেখা শেষে ওখানকার ক্যান্টিনটা দেখার স্বাধ হলো । দেখলাম।একেবারে ব্যস্ততম একটি রেষ্টুরেন্টরের মতো। স্ন্যাকস , মেনু সব আছে। দামটা চড়া। তাতে কি লোকে ভরপুর ।মনে হলো যত না চিকিৎসা তার চেয়ে বেশী আনুসঙ্গিক ব্যবসা। চিকিৎসা, ব্যবস্থাপনা, খাবার, সার্ভিস , প্যাথলজি …. চারদিকে কেবল ।আয়, আয় আর আয়।অথচ দেশের দুঃসময়ে সহায়তার হাত বাড়াতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিলো ।
করোনা সংক্রমনের শুরুর দিকে এসব হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করে।নানা অযুহাত ছিলো। পিপিই নাই, ভালো মাক্স নাই, ভেনটিলেশান নাই, অক্সিজেন কম ,আইইসিউ, সিসিইউ কম , ডাক্তার নার্সদের নিরাপত্তা নাই।
পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনায় কাজ শুরু হয়। দেখা গেছে প্রথমদিকে হাসপাতাল খোলা থাকলেও ডাক্তার নাই, ডাক্তার থাকলে কিট নাই বা রোগী ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।তবে সরকারী হাসপাতাল গুলোতে সব শ্রেণীর রোগী বেশি ছিলো এবং আছে। যদিও ভালো ব্যবস্থাপনা সেখানেও নাই । বর্তমানে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। অগণিত টেষ্ট হচ্ছে , রোগী ভর্তি হচ্ছে ,চিকিৎসা নিচ্ছে তবে করোনার মতো সংক্রমণ যুদ্ধেজয়ী হবার সঠিক ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নাই বললে চলে।
বেসরকারি হাসপাতালটিতে যে ৫ জন করোনা রোগী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলেন তাতে এটি স্পষ্ট যে এখানে ভয়ানক অবহেলা কাজ করেছে ।পাশাপাশি হয়ত তাদের মনে হয়েছে এ সব রোগী থেকে প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব হবে না ।বিনিয়োগের টাকাও উঠে আসবে না। অযথাই খরচ বাড়বে।এটি তাদের করোনা রোগীর মতো বাড়তি ঝামেলা না নেবার ফন্দি নয় তো ?
তারা ভেবে দেখেনি চারদিকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে অসহায়ত্ব তৈরী হয়েছে তা থেকে কেউ মুক্ত নয়।বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারনে কথায় কথায় চিকিৎসার নামে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ভারত, লন্ডন উড়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। ভেবে দেখুন এ মুহূর্তে অসুস্থ হলে আপনাকে ও হয়তো আপনারই গড়া প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে হতে পারে । তখন কি উপলব্ধি করবেন কোন ধরনের চিকিৎসা আপনার প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে । প্যাকেজ চিকিৎসার নামে কি বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন । জরুরী ব্যবস্থা বলে কিছু রাখা প্রয়োজন কিনা।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় আজকাল বাংলাদেশে মিডিয়া, হাসপাতাল ,ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার, ঔষধ শিল্পের মালিক হবার জন্য কোন বাধাধরা নিয়ম নাই।যার অর্থ এবং লিয়াজো আছে সে সংশ্লিষ্ট পেশায় সম্পৃক্ত না হলেও অনুমোদন পেয়ে যায়।সবচেয়ে দুর্বল দিকটি হলো অনুমোদন দেবার পর যথাযথ ভাবে সেবা দিচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য কার্যকরী মনিটরিং এর ব্যবস্থা নাই।
এক হিসেবে দেখা গেছে , বর্তমানে দেশে সরকারি – বেসরকারি মিলিয়ে ৫৮১৬ টি হাসপাতাল রয়েছে(২০১৫ হিসাব) , অগনিত ডায়গনিষ্টিক সেন্টার রয়েছে। রয়েছে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রচুর কমিউনিটি ক্লিনিক ।গত পাঁচ বছরে এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।তবে চিকিৎসার সকল ব্যবস্থাপনা একটি কেন্দ্রবিন্দু থেকে চালানোর কোন ব্যবস্থা বা মানদন্ড এখনও গড়ে ওঠেনি বলে দেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক বৈষম্য ও নৈরাজ্য গড়ে উঠেছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিক মুনাফা আয়ের অদ্ভুত এক প্রতিযোগীতা কাজ করে। যদিও বা বর্তমান বাংলাদেশে মানুষের খরচের সক্ষমতা ও সামর্থ্য আগের চাইতে বেড়েছে বলে ভালো চিকিৎসা পাবার জন্য যে কোন উপায়ে অর্থ খরচ করতে কেউই পিছপা হয় না ।ফলে এমনিতেই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গুলো লাভবান হচ্ছে।
শুধু তাই না জনসংখ্যাধিক্যের কারনে বাংলাদেশে কোন ব্যবসাই অলাভজনক হবার কথা না।চিকিৎসা খাত তো নয়ই।এখানে ডাক্তার, প্যাথলজিষ্ট,ঔষধ কোম্পানী, ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার সবাই সম্মিলিতভাবে লাভবান হচ্ছে ।
এমনিতে এখন পর্যন্ত মানুষ চিকিৎসার সিংহভাগ তার নিজ পকেট থেকে খরচ করছে।এ খরচ করতে যেয়ে কখনও বা ভিটা মাটিও বিক্রি করতে হয়। এর পরও সাধারন জন কখনও কোন অভিযোগ পর্যন্ত করে না ।এতটা ছাড় দেবার পরও যদি দেশের সংকট সময়ে কয়েকটা মাসের মুনাফা লাভের ব্যাপারে ছাড় দিতে না পারে তাহলে কঠোর নির্দেশনা ছাড়া কোন বিকল্প নাই। বরং সংকটকালে যিনি বা যারা হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন,আছেন তাদের চির তরে হাত গুটিয়ে বসে থাকার ব্যবস্থা করা উচিত নয় কি ?
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিভিন্ন দেশে ধনী এবং সেলিব্রেটিরা সেবামূলক মানবিক কাজে বিনিয়োগ করেন। ।অত্যন্ত দরদ দিয়ে কাজটি করেন। তারা জানেন যে সেবা তৈরী করছেন তা থেকে সবার সাথে তাকে ও সেবা নিতে হতে পারে তার জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা থাকবে না।বাংলাদেশে কোন সেলিব্রেটির মাঝে এ প্রবনতা দেখা যাচ্ছে । লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বলেছিলেন, ‘আমি ইশ্বর ও মানবতাকে আঘাত করেছি। কেননা আমার কাজ যতটা ভালো হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি’ – এমনি আত্ম সচেতনতা কি আমাদের কর্তাব্যক্তিদের মাঝে আসবে?
অতি সম্প্রতি লন্ডন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েল্থ এক্স এর রিপোর্টে দেখা গেছে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত হারে বাড়ছে যে সব দেশ তার তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম । ১৭’৩% হারে এর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১২ থেকে এই হার বাড়ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত কয়েক বছর ধরে বেশ ভালো । বর্তমানে ঔষধ, শিল্প, সেবা খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে । দেশে সেবা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে । এক্ষেত্রে কতৃর্পক্ষের কাছে অনুরোধ, অনুমোদন দেয়ার সময় সহনীয় মুনাফা লাভের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন । সকলে যাতে সেবা পায় সেটির ও নির্দেশনা থাকতে হবে।
আমরা জানি ক্রাইসিস মানুষকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে । ভুল চিহ্নিত করে নতুন পথের সন্ধান দেয়।এযাবৎকাল স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়নি। প্রতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে কিছুটা বরাদ্দ বাড়ালেও সার্বিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা বা সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি একেবারে আমলে নেয়া হয়নি।
এবার বিশ্বজোড়া উপলব্ধি হয়েছে স্বাস্থ্য খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়াতে হবে , সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা এবং মনিটরিং এর সুব্যবস্থ্যা গড়ে তুলতে হবে, সমতা ভিত্তিক সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থ্যা থাকতে হবে। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোকে এক কেন্দ্র থেকে পরিচালনার ব্যবস্থ্যা রাখতে হবে। সংকট সময়ের পূর্বে পরিকল্পনা ও জরুরি বাজেট রাখতে হবে । একাজগুলো করার জন্য আর কোন সময় নষ্ট করা যাবে না ।মাদার তেরেসার ভাষায় আমাদেরকে ও বলতে হবে আমাদের কাছে আজকের দিনটি এখনই শুরু করতে হবে নয়ত বার বারই আমাদের কে নতুন নতুন মহামারির সাথে যুদ্ধ করতে হবে না হয় মরতে হবে। সবশেষে বাংলাদেশের আশু বাজেট পরিকল্পনায় এ সব বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
তাই রবার্ট এইচ স্কুলারের মতো বলতে চাই – ‘সমস্যা তোমাকে থামিয়ে দেবার জন্য আসে না ।সে আসে , যাতে তুমি নতুন পথ খুজে পাও’ । আমরা সে পথের সন্ধানে অপেক্ষমান । তাই ,তুচ্ছ হোক অধিক মুনাফা , মূখ্য হোক মানবতা। জয় মানবতার।